স্টেমসেল কি শুধুই পরাবাস্তবতা !!!
মানুষের ত্বক থেকে কয়েকটা কোষ নিয়ে যদি গবেষণাগারে একটা যকৃত বা লিভার তৈরি করা যায়, ভাবতে কেমন লাগবে! বিষয়টা এখন আর শুধু ভাবনাতে নেই। জাপানি বিজ্ঞানী কাজুকি তাকেইশি ও তাঁর দল পুরোপুরি কার্যকর একটা ‘মিনি-লিভার’ তৈরি করে দেখিয়েছেন। এই টেকনোলজি কাজে লাগানো গেলে রোগীর শরীর থেকে কোষ নিয়ে ল্যাবে তৈরি হবে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যা মানব শরীরে প্রতিস্থাপন করা যাবে।
পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, শুধুমাত্র আমেরিকাতেই ৩০ মিলিয়ন মানুষ লিভারের অসুখে ভুগছে, যার মধ্যে প্রায় ৪০,০০০ জন রোগের শেষ পর্যায়ের অবস্থায় আছেন। এই ক্রিটিক্যাল অবস্থার একমাত্র চিকিৎসা লিভার ট্রান্সপ্লান্ট। এই মুহূর্তে আমেরিকার প্রায় ১৭,০০০ হাজার মানুষ লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করার জন্য অপেক্ষামান। প্রতিটি ট্রান্সপ্লান্টে গুণতে হবে হাজার হাজার ডলার। তার সাথে রয়েছে বাকি জীবনব্যাপি ইম্যিউন-প্রতিরোধী (immunosuppressant) ব্যয়বহুল ওষুধের বোঝা।
মানুষের শরীরে দু’শ এর বেশি প্রকারের কোষ রয়েছে। যদিও এই সকল কোষ মাতৃগর্ভস্থ ভ্রূনের বিশেষ প্রকারের স্টেম সেল (Embryonic Stem cell বা ES cell) থেকে আসে। এই ES cell গুলো Pluripotent cells, যা থেকে মানুষের শরীরের যেকোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরি করা সম্ভব। ভ্রূণ দশা পার হবার পর আর এই স্টেমসেল শরীরে পাওয়া যায় না। কোনোভাবে যদি পূর্নবয়স্ক মানুষের শরীরের সেলকে স্টেমসেল দশায় ফেরত পাঠানো যেতো তাহলে রোগাক্রান্ত বা ক্ষয়িষ্ণু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে পূনর্জন্ম বা মেরামত করা সম্ভব হতো। এই ভাবনাকে এগিয়ে নিতেই জাপানি বিজ্ঞানী শিনআ ইয়ামানাকা ও তার দল আবিস্কার করেন Reprogramming Technology, যা দ্বারা একটি পূর্ণবয়স্ক মানুষের যেকোন কোষকে ES-like cells -এ পরিণত করতে পারেন। যাকে বলা হয়েছে induced Pluripotent Stem cells বা iPS cells । এই আবিস্কারের স্বীকৃতি স্বরূপ Sir John B Gurdon এর সাথে ২০১২ সালে শিনআ ইয়ামানাকা যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। এই কৌশলকে কাজে লাগিয়ে শরীরের যেকোন কোষকে মাতৃগর্ভ কালীন ভ্রূণস্থ কোষ (ES cells) এর মত স্টেম সেল (iPS cell) দশায় ফিরিয়ে নেয়া যায়। পরবর্তীতে প্রাপ্ত iPS cell যা থেকে পূণরায় শরীরের যেকোন কোষে পরিণত করা যায়। সেই কাজের ধারাবাহিকতায় বিজ্ঞানী কাজুকি তাকেইশি ও তাঁর দল কিছু সংখ্যক মানুষের ত্বকের কোষ (Fibroblast)-কে Reprogramming Technology -এর মাধ্যমে iPS cells -এ পরিণত করেন। পরবর্তীতে নির্দিস্ট জৈব রাসায়নিক পদার্থ (transcription factor)-এর উপস্থিতিতে যকৃতের বিভিন্ন প্রকারের কোষে (hepatocytes, biliary epithelial cells, and vascular endothelial cells) পরিণত করেন। পরিবর্তিত এই কোষসমূহকে একটি কোষবিহীন (de-cellularized scaffold) ইঁদুরের যকৃতের কাঠামোতে প্রবেশ করিয়ে উপযুক্ত পুস্টি সরবরাহকরণ সহ শারীরবৃত্তীয় পরিবেশে (organ-like microenvironment) কালচার করা হয়। মাত্র এক মাসের মধ্যেই বায়ো-রিএ্যাক্টরে তৈরি হয়ে যায় ‘মিনি-লিভার’, যা ইঁদুরের দেহে প্রতিস্থাপন করা হয় এবং চার দিন পর পোস্টমর্টেম এ্যানালাইসিসের জন্য ইঁদুরগুলোকে স্যাকরিফাইস করা হয়। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে এই এক্সপেরিমেন্টের একটা গবেষনাপত্র ‘Cell Reports’ জার্নালে প্রকাশিত হয়। প্রয়োজনীয় পরীক্ষাসমূহের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা গেছে যে মানব যকৃত যেসব প্রয়োজনীয় উপাদান তৈরি করে, যেমন- প্রোটিন, পিত্ত (bile), ইউরিয়া ইত্যাদি, ‘মিনি-লিভার’ও সেসব উপাদান তৈরি করতে সক্ষম।
ত্বকের কোষ থেকে উৎপাদিত মিনি-লিভারের কার্যকারিতা বিজ্ঞানী দলকে আরো প্রত্যয়ী করে তুলেছে। তারা খুব শীঘ্রই দীর্ঘজীবি প্রাণীতে নিরীক্ষন শেষে মানব শরীরে প্রতিস্থাপন করবেন। আর সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে বিজ্ঞানীগণ আগামী দশ বছরের মধ্যেই চিকিৎসগণের হাতে রোগীর/অন্য কারো ত্বকের কোষ দিয়ে ল্যাবে তৈরি যকৃত (Universal Liver Graft) তুলে দিতে পারবেন বলে তারা আশাবাদী।
তথ্যসূত্র: https://doi.org/10.1016/j.celrep.2020.107711
Last Updated on 23/06/2020 by Editorial Staff
Comments
স্টেমসেল কি শুধুই পরাবাস্তবতা !!! — No Comments
HTML tags allowed in your comment: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>