ভ্রূণের থ্যালেসেমিয়া নির্ণয় (Prenatal Diagnosis)
থ্যালাসেমিয়া একটি জটিল জন্মগত ও প্রতিরোধ যোগ্য রক্তরোগ। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই থ্যালাসেমিয়ার বা অন্য কোন ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিনের (Pathological Hemoglobin)-এর বাহক (Carrier/Trait) হলেই কেবলমাত্র তাদের সন্তান থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জন্মাতে পারে।তবে এক্ষেত্রে সন্তান জন্মের আগেই পরীক্ষা করে জানা সম্ভব সন্তান থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হবে কি-না। এই পরীক্ষাকে সাধারণভাবে আমরা বলি ভ্রূনের রোগ নির্ণয় বা প্রি-নেটাল ডায়াগনোসিস । শিশু যখন মাতৃজঠরে (Mother’s womb) থাকে তখন সন্তান প্রসবের অনেক আগেই ভ্রূন (Embryo) পরীক্ষার দ্বারা শিশু থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হবে কিনা তা বলে দেয়া যায়। এ পরীক্ষা করা হয় যখন স্বামী এবং স্ত্রী উভয়েই থ্যালাসেমিয়ার বা অন্য কোন ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিনের (Pathological Hemoglobin)-এর বাহক (Carrier/Trait) হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, স্বামী বা স্ত্রীর মধ্যে যদি একজন বাহক ও অন্যজন সুস্থ্য থাকে, তাহলে এ পরীক্ষা করার প্রয়োজন নেই। যদি পরীক্ষায় দেখা যায় ভ্রণের থ্যালাসেমিয়ার মিউটেশন (Mutation) আছে এবং থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুর জন্ম হবে, তখন আগত শিশুর মারাত্বক পরিনতির কথা বিবেচনায় নিয়ে গর্ভপাত (Abortion) বা প্রেগন্যান্সি টারমিনেশন (Termination of pregnancy) এর সুযোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে এটা স্বামী-স্ত্রীর বা দম্পতির (Couple) একান্তই নিজস্ব ব্যাপার।
সাধারণত নিম্নলিখিত তিন রকমের পরীক্ষার দ্বারা ভ্রূণের থ্যালাসেমিয়া নির্ণয় করা যেতে পারে:
১) মাতৃজঠরের পানি পরীক্ষা (Amniocentesis),
২) কোরিওনিক ভিলাস পরীক্ষা (Chorionic villi sampling) এবং
৩) ফিটাল ব্লাড পরীক্ষা (Cordocentesis)
(১) মাতৃজঠরের পানি পরীক্ষা (Amniocentesis):
এ পরীক্ষা করা হয় মায়ের গর্ভাবস্থার সাধারণত ১৫ সপ্তাহ পরে। মায়ের গর্ভে বাচ্চা এক ধরণের তরল পদার্থের মধ্যে ভাসমান অবস্থায় থাকে যাকে এ্যমনিওটিক ফ্লুইড (Amniotic fluid) বলা হয়। একজন ধাত্রীবিদ্যা বিশেষজ্ঞ (Obstetrician) আল্ট্রাসনোগ্রাফির (USG) সাহায্যে মায়ের পেটে একটি সরু সূচ ঢুকিয়ে এবং একটি সিরিঞ্জের মাধ্যমে পানি ১৫-২০ মিলি তরল পদার্থ সংগ্রহ করে যার মধ্যে ভ্রূন কোষগুলো ভেসে থাকে। পরে ল্যাবরেটরিতে এই পানি থেকে প্রথমে ভ্রূন কোষগুলোকে আলাদা করা হয় এবং পরে তা পিসিআর (PCR) ল্যাবে বিশদভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা (Analysis) করা হয়। অতঃপর পরীক্ষা শেষে বলে দেয়া হয় নমুনা ভ্রূণের থ্যালাসেমিয়া জীন আছে কি-না এবং শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হবে কি-না। এ পদ্ধতিতে গর্ভপাতের কিছুটা সম্বাবনা বা ঝুঁকি থাকে যদিও তা অনেক কম (০.৫%)।
(২) ফিটাল ব্লাড পরীক্ষা (Cordocentesis):
এ পরীক্ষা করা হয় মায়ের গর্ভাবস্থার ১৮-২০ সপ্তাহের মধ্যে। তবে ১৮ সপ্তাহের আগে করলে তাতে পরীক্ষার সফলতার হার অনেক কম। এখানেও আল্ট্রাসনোগ্রাফির (USG) সাহায্যে একটি সিরিঞ্জযুক্ত সরু সূচ মায়ের পেটে ঢুকিয়ে আমব্লিকাল কর্ড (Umbilical cord) থেকে ফিটাল ব্লাড সংগ্ৰহ করা হয়। তারপর এ রক্ত থেকে ভ্রূণ কোষগুলো আলাদা করে এবং তা পিসিআর (PCR) পরীক্ষার মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে বলে দেয়া যায় যে ভ্রুণটিতে থ্যালাসেমিয়ার জিন (Gene) আছে কিনা এবং সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হবে কি-না? এ পরীক্ষা পদ্ধতির ও কিছু পাশ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে যেমন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ (Bleeding), প্রদাহ (Infection), গর্ভপাত (Abortion) এবং পেটের ছিদ্রপথে মাতৃজঠরের পানির নির্গমন ইত্যাদি।
(৩) কোরিওনিক ভিলাস পরীক্ষা (Chorionic Villi sampling):
এ পদ্ধতিটি সবচেয়ে সহজ এবং আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত কারণ এখানে মায়ের গর্ভাবস্থার ১০-১২ সপ্তাহের মধ্যেই নমুনা সংগ্রহ করা যায়। এখানে দু’রকম ভাবে কোরিওনিক ভিলাস (Chorionic villi) সংগ্ৰহ করা যেতে পারে।
(ক) ট্রান্সএ্যবডোমিনাল (Transabdominal CVS) পথে মায়ের পেটের মধ্যে দিয়ে একটি সরু সূচ দিয়ে কোরিওনিক ভিলাস (Chorionic villus) সংগ্ৰহ করা হয় এবং পরে তা পিসিআর অথবা জিনোম সিকোয়েন্স (Genome sequence)-এর মাধ্যমে এনালাইসিস (Analysis) করা হয়।
(খ) ট্রান্সসারভাইকাল (Transcervical CVS) -এখানে যোনিপথে (Vagina) একটি ক্যাথেটার ঢুকিয়ে কোরিওনিক ভিলাস তথা ভ্রূণের কোষ সংগ্ৰহ করা হয়। তারপর ডিএনএ (DNA) ল্যাবরেটরিতে এই কোষগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বলে দেয়া যায় যে ভ্রণটিতে থ্যালাসেমিয়া জিন আছে কিনা এবং সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হবে কি-না? এখানে কিছু পাশ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা থাকে যেমন গর্ভপাত (Spontaneous abortion), অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ (Bleeding)ও প্রদাহ (Infections) ইত্যাদি।
বর্তমান বিশ্বে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে আরো উন্নতর পদ্ধতির প্রয়োগ দিন দিন বেড়েই চলেছে তারমধ্যে নিচের তিনটি PND পদ্ধতি বহুল আলোচিত।
(১) ছিলোসিনটেসিস (Celocentesis): এটা নতুন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে আমরা ৭-৮ সপ্তাহের মধ্যেই ভ্রূণের থ্যালাসেমিয়া নির্ণয় করতে পারি। এখানেও আল্ট্রাসনোগ্রাফির সহায়তায় এক্সট্রা এ্যমনিওটিক ফ্লুইড (Celomic fluid) সংগ্ৰহ করে পরে ডিএনএ পরীক্ষা করা হয় ভ্রূণের থ্যালাসেমিয়া জিন (gene) বা মিউটেশন আছে কিনা তা নির্ণয় করা হয়। এ পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো যদি গর্ভপাতের প্রয়োজন হয়, সেক্ষেত্রে গর্ভপাত পরবর্তী জটিলতা অনেকটা শূন্যের কোঠায়। এ পদ্ধতিতে বিশুদ্ধ ফিটাল টিস্যু কালেকশন হয় যার মাধ্যমে পরবর্তীতে নির্ভরযোগ্য ডিএনএ এনালাইসিস করে বলে দেয়া যায় ভ্রণটিতে থ্যালাসেমিয়ার মিউটেশন আছে কি-না?
(২) প্রি-ইমপ্লান্টেশন জেনেটিক ডায়াগনোসিস (Preimplantation genetic diagnosis): এ পদ্ধতিটি বর্তমানে খুবই জনপ্রিয় এবং এখানে গর্ভপাতের প্রয়োজন নেই কারণ আগেই কোষের পরীক্ষা করে সুস্থ (Unaffected blastomeres) কোষগুলোকে পরবতীতে মায়ের জরায়ুতে স্থানান্তর করা হয়। এখানে ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (in-vitro fertiliation) এর মাধ্যমে ব্লাস্টমেয়ার (Blastomeres) থেকে এক বা দুটো কোষ সংগ্ৰহ করা হয় এবং পরবর্তীতে সেগুলো culture করে ৩য় দিনে যখন ৬-১০ কোষর ব্লাস্টমেয়ার পর্যায়ে আসে, তখন সেই কোষগুলোকে PCR পরীক্ষা করে গ্লোবিন জিনের গঠন বিশ্লেষণ করা হয়। যে কোষগুলোতে মিউটেশন বা কোষের স্থায়ী পরিবর্তন থাকে না সেগুলোকে নির্বাচন করা হয় এবং পরবর্তীতে তা মায়ের জরায়ূতে প্রতিস্থাপন (In-vivo implantation or fertilization) করা হয়। যে দম্পতিরা Termination of pregnancy (TOP) অপছন্দ করে, তাদের জন্য এটি সবচেয়ে আদর্শ ও নিরাপদ পদ্ধতি।
(৩) Placentacentesis: – এটা নিয়ে খুব বেশি অভিজ্ঞতা নেই, গবেষণা চলছে।উপরোক্ত প্রি-নেটাল ডায়াগনোসিস-এর বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে গ্ৰহণযোগ্যতায় এগিয়ে আছে CVS (৯৯.৩%), তারপর যথাক্রমে Amniocentesis (৯৬.৪%) এবং FBS (৯৩.২%)!
Source: From prenatal to Preimplantation genetic diagnosis Beta-Thalassemia. Journal of clinical medicine. Giovanni Monni et all.
Last Updated on 05/08/2021 by Editorial Staff
Comments
ভ্রূণের থ্যালেসেমিয়া নির্ণয় (Prenatal Diagnosis) — No Comments
HTML tags allowed in your comment: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>