বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনই একমাত্র নিরাময়যোগ্য চিকিৎসা
থ্যালাসেমিয়া একধরনের রক্তশূন্যতা, যা বংশগতভাবে বিস্তার লাভ করে। থ্যালাসেমিয়ায় স্বাভাবিক হিমোগ্লোবিন তৈরির হার কমে যায়। তবে কতটা কমে, তা নির্ভর করে একটা অথবা দুটো জিনই ত্রুটিপূর্ণ কি না তার ওপর। আন্তর্জাতিক থ্যালাসেমিয়া দিবসে লিখেছেন অধ্যাপক ডা. এম এ খান
চার বছরের একমাত্র সন্তান মুক্তা। এক বছর বয়স থেকে তার রক্তের হিমোগ্লোবিন কমতে থাকে, মাসে মাসে রক্ত দিতে হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানা গেল, সে ত্রুটিপূর্ণ জিন পেয়েছে। তার বাবা ও মা উভয়েই থ্যালাসেমিয়ার বাহক। প্রতি মাসে ব্লাড ট্রান্সফিউশন, দেহে জমে ওঠা আয়রন চিলেশনের জন্য প্রতিদিন খেতে হয় কত না ওষুধ। এত রক্ত, এত কষ্ট আর তারা সইতে পারছে না। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোনো উপায় কি নেই?
থ্যালাসেমিয়া একধরনের রক্তশূন্যতা, যা বংশগতভাবে বিস্তার লাভ করে। থ্যালাসেমিয়ায় স্বাভাবিক হিমোগ্লোবিন তৈরির হার কমে যায়। তবে কতটা কমে, তা নির্ভর করে একটা অথবা দুটি জিনই ত্রুটিপূর্ণ কি না তার ওপর। থ্যালাসেমিয়া বাহকের বেলায় একটি এবং থ্যালাসেমিয়া মেজরের বেলায় দুটি জিনই ত্রুটিপূর্ণ থাকে। থ্যালাসেমিয়ার প্রার্দুভাব মেডিটেরিয়ান, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ান দেশগুলোয় বেশি। বাংলাদেশে প্রায় ৭-১০% হিমোগ্লোবিন-বিটা ও হিমোগ্লোবিন-ই–এর বাহক রয়েছে। ১৭ কোটি মানুষের দেশে প্রায় দুই কোটি মানুষ থ্যালাসেমিয়ার বাহক এবং প্রতিবছর প্রায় সাত হাজার শিশু হিমোগ্লোবিন-ই/বিটা ই/বিটা ও থ্যালাসেমিয়া মেজর নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে।বিজ্ঞাপন
বেশির ভাগ থ্যালাসেমিয়া রোগীর নিয়মিত রক্ত দিতে হয়। কারণ, ব্লাড ট্রান্সফিউশন ছাড়া তাদের হাড়ের বিকৃতি দেখা দেয়, সেই সঙ্গে লিভার ও স্প্লিন বড় হয়ে যায়। রক্ত না নিলে জীবন বাঁচে না; আবার নিয়মিত রক্ত নিলে শরীরের নানা অংশে (বিশেষ করে লিভার, হার্ট, এন্ড্রোক্রাইনগ্রন্থি) বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এ যেন শাঁখের করাত। তাই সুস্থ জীবনের জন্য প্রতিনিয়ত ব্লাড ট্রান্সফিউশন ও আয়রন চিলেশন অপরিহার্য। নিয়মিত সারা জীবন মেডিকেল থেরাপি অর্থাৎ ব্লাড ট্রান্সফিউশন ও আয়রন চিলেশন সব রোগীর পক্ষে সম্ভব হয় না। কারণ, এর জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়। প্রতিবছর কমপক্ষে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা প্রয়োজন হয়। থ্যালাসেমিয়া রোগী যারা নিয়মিত ব্লাড ট্রান্সফিউশনের ওপর নির্ভরশীল তাদের জন্য বোনম্যারো অ্যালোজেনিক ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন একমাত্র নিরাময়যোগ্য চিকিৎসা। তবে অটোলগাস বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন ব্যবহার করে জিনথেরাপির ব্যবহার এখনো সীমিত ও পরীক্ষাধীন।বিজ্ঞাপন
বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের সুবিধা
ক. থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য একটি নিরাময়যোগ্য চিকিৎসা পদ্ধতি।
খ. সঠিক রোগীদের বেলায় ৮৭-৯০% পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব।
গ. সারা জীবনের ব্লাড ট্রান্সফিউশন ও চিলেশন চিকিৎসা ব্যয় থেকে রেহাই পাওয়া যায় এবং সেই সঙ্গে মেলে থ্যালাসেমিয়ামুক্ত জীবন।
ঘ. এককালীন ৮-১০ লাখ টাকার প্রয়োজন হলেও তা সারা জীবনের ব্লাড ট্রান্সফিউশন ও চিলেশন চিকিৎসা ব্যয় থেকে অনেক কম হবে।
থ্যালাসেমিয়ায় বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশনের চ্যালেঞ্জসমূহ
ক. উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর ও ব্যয়বহুল এককালীন চিকিৎসা পদ্ধতি।
খ) সঠিকভাবে উপযুক্ত থ্যালাসেমিয়া রোগী নির্বাচন করা।
গ) উপযুক্ত বোনম্যারো ডোনার পাওয়া।
ঘ) ট্রান্সপ্ল্যান্ট–পরবর্তী জঠিলতা যেমন GVHD, Graft failure ইত্যাদি।
বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট-এর জন্য কারা উপযুক্ত
ভালো ফলাফল পেতে ও ট্রান্সপ্ল্যান্টের জঠিলতা কমাতে সঠিকভাবে উপযুক্ত থ্যালাসেমিয়া রোগী নির্বাচন করা অপরিহার্য।
ক. যারা নিয়মিত ও কঠোরভাবে ব্লাড ট্রান্সফিউশন ও চিলেশন নিয়ে থাকেন।
খ. ১৪ বছরের কম শিশু, যাদের শুরু থেকেই আয়রন নিয়ন্ত্রণে এবং লিভার স্বাভাবিক রয়েছে।
গ. এইচএলএ ম্যাচ ডোনার যাদের রয়েছে।
উল্লিখিত বিষয়গুলো ভালোভাবে মেনে বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট করলে ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া মৃত্যুঝুঁকি ৪ শতাংশ কমানো সম্ভব হবে।
থ্যালাসেমিয়া রোগীদের প্রথম বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন শুরু হয় ১৯৮২ সালে ইতালিতে পেসারিও গ্রুপের মাধ্যমে। পেসারিও গ্রুপ একটি প্রগনোস্টিক সিস্টেম তৈরি করে, যার মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের তিনটি রিস্ক ফ্যাক্টরের মাধ্যমে তিনটি গ্রুপে ভাগ করে, যা ট্রান্সপ্ল্যান্ট–পরবর্তী বেঁচে থাকার সম্ভাব্য পূর্বাভাস দেয়।
আয়রন চিলেশনের গুরুত্ব
রিস্ক ফ্যাক্টর পর্যালোচনা করে বোঝা যায় সঠিক ও নিয়মিত চিলেশন কতটা গুরুত্ব বহন করে বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের বেলায়। দীর্ঘদিন অধিক আয়রনের উপস্থিতি দেহের অনেক অঙ্গ বিশেষ করে লিভার (লিভার সিরোসিস) ও হার্টের (হার্ট ফেইলিউর) ক্ষতি করে, যা পরে বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের ফলাফল অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায় (প্রায় ৩০-৩৫% পর্যন্ত)। যেসব থ্যালাসেমিয়া রোগী বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট করাতে চান তাদের শুরু থেকেই নিয়মিত এবং কঠোরভাবে আয়রন চিলেশনের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে এবং প্রথম ব্লাড ট্রান্সফিউশনের ১৮ মাসের মধ্যে চিলেশন থেরাপি আরম্ভ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, ট্রান্সপ্ল্যান্টের কয়েক মাস আগে থেকে আয়রন চিলেশন করলেই ট্রান্সপ্ল্যান্টের কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া যাবে না, কারণ ইতিমধ্যে আয়রনজনিত জটিলতা শুরু হয়ে যায়।
কোন বয়সে বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা উচিত
থ্যালাসেমিয়া রোগীদের শিশুকালে যথাসম্ভব অল্প বয়সে বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। কারণ, এতে অধিক আয়রনজনিত জটিলতা এড়ানো সম্ভব হয়। যদিও ট্রান্সপ্ল্যান্টের সুনির্দিষ্ট কোনো বয়সসীমা বেঁধে দেওয়া হয়নি। তবে ১৪ বছরের কম বয়সে ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হলে থ্যালাসেমিয়ামুক্ত বেঁচে থাকার সম্ভাবনা প্রায় ৮৩-৯৩% এবং সেই সঙ্গে ট্রান্সপ্ল্যান্টজনিত মৃত্যুহার কমে যায় প্রায় ৪ শতাংশ। যেসব প্রাপ্তবয়স্ক থ্যালাসেমিয়া রোগী অনিয়মিতভাবে ব্লাড ট্রান্সফিউশন ও চিলেশন থেরাপি গ্রহণ করে থাকে তাদের বেলায় বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টের পরিবর্তে মেডিকেল থেরাপি এবং Luspatercept চিকিৎসা প্রযোজ্য।
ডোনার নির্বাচন
বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টের জন্য ডোনার (যিনি স্টেমসেল দান করবেন) নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
ক. থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য সম্পূর্ণ এইচএলএ ম্যাচ (৬/৬) ভাইবোন যাদের থ্যালাসেমিয়া মেজর বা হিমোগ্লোবিন-ই/বিটা থ্যালাসেমিয়া থাকবে না, তাকে আদর্শ ডোনার হিসেবে গ্রহণ করা হয়। তবে থ্যালাসেমিয়া বাহক (মাইনর) ডোনার হতে পারবেন।
খ. যাদের এইচএলএ ম্যাচ ভাইবোন নেই সে ক্ষেত্রে জাতীয় অথবা আন্তর্জাতিক বোনম্যারো রেজিস্ট্রি থেকে অনাত্মীয় ডোনার নির্বাচন করা যেতে পারে।
গ. বিশেষ ক্ষেত্রে হ্যাপ্লো–আইডেন্টিক্যাল ডোনার হিসেবে ভাইবোন ও বাবা-মাকেও নির্বাচন করা যেতে পারে।
থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য সম্পূর্ণ ম্যাচ ডোনার পাওয়া কষ্টকর। কারণ, সাধারণভাবে ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে ভাইবোনদের মধ্যে সম্পূর্ণ এইচএলএ ম্যাচ ডোনার পাওয়া যায়। কিন্তু থ্যালাসেমিয়া পরিবারে অন্য ভাইবোনেরা থ্যালাসেমিয়া মেজর (২৫ শতাংশ) হতে পারে। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনাত্মীয় ডোনার বা হ্যাপ্লো–আইডেন্টিক্যাল ডোনারের ওপর নির্ভর করতে হয়। ম্যাচ ভাইবোন ডোনার, ম্যাচ অনাত্মীয় ডোনারের চেয়ে উত্তম। কারণ, কিছু অ্যান্টিজেনিক পার্থক্য থাকার ফলে অনাত্মীয় ডোনারের বেলায় Graft-versus host disease (GVHD) বেশি হয়। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, থ্যালাসেমিয়ামুক্ত বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ম্যাচ ভাইবোন ডোনার, ম্যাচ অনাত্মীয় ডোনার ও হ্যাপ্লো-আইডেন্টিক্যাল ডোনারের বেলায় যথাক্রমে ৮৩%, ৭৭% এবং ৬৮%।
বোনম্যারো ডোনার রেজিস্ট্রি
২৫-৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ম্যাচ ভাইবোন ডোনার পাওয়া যায় ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অনাত্মীয় বোনম্যারো ডোনারের ওপর নির্ভর করতে হয়। ব্লাড ডোনেশন সংস্থার মতো স্বেচ্ছায় যারা বোনম্যারো স্টেমসেল ডোনেট করতে চায় তাদের নিয়ে দেশে দেশে জাতীয়ভাবে বা আন্তর্জাতিকভাবে বোনম্যারো ডোনার রেজিস্ট্রি তৈরি করা হয়েছে। যাদের নাম (এইচএলএ টাইপিংসহ) ডোনার রেজিস্ট্রিতে অন্তর্ভুক্ত থাকে, তারা স্বেচ্ছায় অন্যের প্রাণ বাঁচাতে বোনম্যারো (স্টেমসেল) ডোনেট করেন। আমাদের দেশেও ২০১৯ সালে এমন ‘বাংলাদেশ ম্যারো ডোনার রেজিস্ট্রি (BMDR)’ চালু হলেও এর কার্যক্রম খুবই সীমিত। এর জন্য প্রয়োজন সবার সহযোগিতা।
থ্যালাসেমিয়া রোগীদের একমাত্র নিরাময়যোগ্য চিকিৎসা পদ্ধতি হচ্ছে বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট এবং যথাসময়ে সঠিক নিয়মে এই চিকিৎসা গ্রহণ করলে সম্পূর্ণ নিরাময় হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৯০ শতাংশ। অতএব বাংলাদেশে কয়েক লাখ থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন সুলভে করার উদ্যোগ গ্রহণ করার সময় এখনই।
লেখক: হেমাটোলজিস্ট ও বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট ফিজিশিয়ান, সাবেক বিভাগীয় প্রধান ও প্রতিষ্ঠাতা হেমাটোলজি ও বিএমটি বিভাগ, ডিএমসিএইচ, ঢাকা। উপদেষ্টা, বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সমিতি হাসপাতাল।
Last Updated on 11/05/2022 by Editorial Staff
অনেক অনেক ধন্যবাদ।তবে ডোনারের কি বভিষ্যতে কোন সমস্যা হয় কি না তাজানালে ভালো হত