প্রাণহীন পথিকের ক্লান্ত পথ চলা: রক্তস্বল্পতা
লিখেছেন ডা. মু. জামাল উদ্দীন তানিন
আমাদের দেশের বিশাল জনসংখ্যার বড় একটি অংশই এনিমিয়া বা রক্তসল্পতায় ভুগছেন। কিন্তু তাঁদের বেশির ভাগই এ ব্যাপারে অসচেতন। যার ফলে দৈনন্দিন জীবনে নানা অসুবিধা হওয়ার সাথে সাথে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেকেই জটিল প্রাণঘাতি বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় পরছেন। তাই এনিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা সম্পর্কে সচেতনতা এখন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।
প্রকৃতপক্ষে এনিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজে কোন রোগ নয়। এটি শরীরে লুকিয়ে থাকা অন্য কোন রোগের একটি লক্ষণ। আবার এনিমিয়া অনেক সময় অন্যরোগকে জটিল করে তোলে যেমন হার্টের সমস্যা, জয়েন্টের সমস্যা, স্ট্রোক, পায়ের আঙ্গুল বা পা কেটে ফেলতে হওয়া গ্যাংগ্রিন বা ঘা ইণ্যাদি। আর এই কারণেই এনিমিয়া বা রক্তস্বল্পতার যথাযথ কারণ নির্ণয় ও সঠিক চিকিৎসা খুব দরকারী একটি বিষয়।
এনিমিয়ার প্রধান লক্ষণ হল দুর্বলতা। সব সময় উদ্যমহীনতা আর দৈনন্দিন কাজে শক্তি না পাওয়া। একজন গৃহিণী তার ঘরের স্বাভাবিক কাজ করে অস্বাভাবিক রকম হাঁপিয়ে উঠছেন অথবা ক্লাস নিয়ে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছেন একজন শিক্ষক। অফিসের কাজে শক্তি পাচ্ছেন না অফিসের কর্মচারী বা বস। শ্রম দিতে পারছেন না মেহনতি মানুষ। যেন প্রাণহীন উদ্দমহীনভাবে জীবনের বোঝা বয়ে চলা পথহারা ক্লান্ত শ্রান্ত এক পথিক। হতে পারে তিনি আসলে রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন। স্কুল কলেজ পড়ুয়াদের খারাপ রেজাল্ট, পড়ায় মন না বসা বা অধিক ক্লান্তির কারণ হতে পারে রক্তস্বল্পতা। ছোট বাচ্চাদের ঠিকমত না খাওয়া, ঠিকমত না বাড়া রক্তস্বল্পতার একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ।
রক্তস্বল্পতার একটি প্রধান লক্ষণ হল বুকের মাঝখানে ব্যথা বা চাপ। শ্বাস বড় হয়ে আসা। একটুতেই হাঁফিয়ে যাওয়া বা বুকে ব্যথা করা। অনেক সময় এমন হয় যে, বুকটা ধরফর করছে বা বাতাসের জন্য আকুলি বিকুলি করছে, কিন্তু নি:শ্বাস নিয়ে যেন বুক ভরছেনা যা অধিক রক্তস্বল্পতার লক্ষণ। (এগুলো হার্টের সমস্যায়ও হতে পারে আবার রক্তস্বল্পতা হার্টের সমস্যাকে বাড়িয়ে দিতে পারে।) মাটিতে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালে (যারা লো-কমোড ব্যবহার করেন) মাথা চক্কর দেওয়া বা চোখ অন্ধকার হয়ে আসা রক্তস্বল্পতার একটি লক্ষণ। অনেক রোগী রক্তস্বল্পতার কারণে খাবার গিলতে না পারা বা খাবার গলায় আটকে যাওয়ার সমস্যায় ভোগেন। রক্তস্বল্পতার সাথে কারণভেদে অনেক সময় জন্ডিস, পেটে গলায় বগলে চাকা বা ফোলা, চামড়ায় লাল কাল বিভিন্ন দাগ, গিরা বা জয়েন্ট ফোলা বা ব্যথা, চুল পড়ে যাওয়া, ওজন কমে যাওয়া এসব সমস্যার যে কোনটি থাকতে পারে। রক্তস্বল্পতার একটি ব্যতিক্রম ধরনের লক্ষণ হল উল্টাপাল্টা জিনিস খাওয়া। যেমন বরফ, মাটি, জুতার চামড়া, চাল, দেয়ালের চুন, চুল ইত্যাদি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে পিকা (pica) বলা হয়। এমন মজার আরেকটি লক্ষণ হল বার বার পা নাড়ানো যাকে restless leg syndrome বলা হয়। আর রোগীরা দেখতে মলিন, দুর্বল, ফ্যাকাশে (যেন ভ্যাম্পায়ার রক্ত খেয়ে ফেলেছে), জিহ্বা ও ঠোটের কোনায় ঘা, ভঙ্গুর সোজা হয়ে যাওয়া নখ এসব সমস্যায় ভোগেন। অনেকেরই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়ে সর্দি কাশি জ্বর লেগেই থাকে। অবাক করা ব্যাপার হল অনেক রোগীর অন্য কোন কারণে পরীক্ষা করে দেখা যায় কম বেশি রক্তস্বল্পতা আছে কিন্তু ওনাদের বাহ্যিকভাবে তেমন কোন সমস্যাই থাকে না।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে পুষ্টিকর সুষম খাবারের অভাব রক্তস্বল্পতার প্রধান কারণ। মজার ব্যাপার হল কেবল অভাবী না খেতে পাওয়া মানুষ নয় তাঁদের সাথে অধিক খেয়ে বিশাল বপু বানিয়ে ফেলা ধনবান ব্যক্তিরাও সুষম পুষ্টির অভাবে রক্তস্বল্পতায় ভোগেন। ফাস্টফুড খাওয়া স্থুল বাচ্চাদের মধ্যেও রক্তস্বল্পতা দেখা যায়। এনিমিয়ার আর একটি প্রধান কারণ হল কৃমির আক্রমণ। মহিলাদের ও কিশোরীদের ক্ষেত্রে রক্তস্বল্পতার প্রধান একটি কারণ হল মাসিকে অতিরিক্ত রক্তপাত। অনেক মহিলাই ম্যানুপস পর্যন্ত সারাজীবন এই সমস্যা বয়ে বেড়ান। গর্ভবতী মা এবং দুগ্ধদানকারী মায়েরা শরীরের অতিরিক্ত চাহিদার কারণে রক্তস্বল্পতায় ভোগেন যা মা ও বাচ্চা দু’জনের জন্যই বিপজ্জনক। প্রসবের সময় রক্তপাত থেকেও রক্তস্বল্পতা তৈরি হয়। যেসব শিশুরা ঠিকমত খায় না আর যাদের ৬ মাস বয়স থেকে মায়ের দুধের পাশাপাশি পুষ্টিকর সুষম খাবার দেওয়া হয় না তাদেরও রক্তস্বল্পতা হয়। বংশগত রক্তস্বল্পতা যেমন থ্যালাসেমিয়া বা হিমোগ্লোবিন ই ডিসিস (haemoglobin E disease) দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় খুব বিস্তৃত একটি রোগ। বাংলাদেশেও এই রোগের প্রকোপ ব্যাপক। মলের সাথে রক্তপাত (যেটি পাইলস বা হ্যামোরয়েড, পলিপ এমন কি মলদ্বার বা বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের একটি লক্ষণ) রক্তস্বল্পতা ঘটাতে পারে। অনেক দিন ধরে গ্যাস্ট্রিক আলসারে ভোগা বা অনেকদিন ধরে নিজে নিজেই গ্যাস্ট্রিক এর ঔষধ খাওয়া রক্তস্বল্পতার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। আবার পাকস্থলীর ক্যান্সারের মত জটিল রোগ কখনো কখনো শুধুমাত্র রক্তের হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার মাধ্যমে ধরা পড়ে। মনে রাখতে হবে, রক্তস্বল্পতার একটি প্রধান কারণ হল শরীরে লুকিয়ে থাকা ক্যান্সার। কিছু জটিল অটোইমিউন ডিজিজ (যেখানে শরীর নিজেই নিজেকে আঘাত করে) রক্তস্বল্পতা ঘটাতে পারে। যেমন এসএলই (SLE), রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস (জয়েন্টের রোগ, গিরা ফুলা)। কিডনি রোগ রক্তস্বল্পতার একটি প্রধান কারণ। আমাদের দেশের অনেক মানুষ নিজে নিজে বা ফার্মেসির ঔষধ বিক্রেতার পরামর্শে বা সাইন বোর্ড দিয়ে ডাক্তার নাম লিখে চেম্বার খুলে বসা যার তার নির্দেশে নানা ঔষধ খান। যা কিডনির ক্ষতি করতে পারে, শরীরে অভ্যন্তরীণ রক্তপাত ঘটাতে পারে। যেমন ব্যথার ঔষধ আর গ্যাস্ট্রিক এর ঔষধ কিডনী নষ্ট করে ফেলতে পারে। ভুল ডোজে, ভুল সময়ে, ভুল ব্যক্তির পরামর্শে এসব ঔষধ খেয়ে অনেকেই রক্তস্বল্পতা ও অন্যান্য সমস্যা নিয়ে আমাদের কাছে আসেন।
যে কথাটি খুব জরুরি সেটি হল যে কোন বয়সেই যে কোন ধরনের রক্তস্বল্পতার জন্যই দুই ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। এক ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা করতে হয় রক্তস্বল্পতার মাত্রা (severity) আর প্রকারভেদ (type) দেখার জন্য। আরেক ধরনের পরীক্ষা করতে হয় রক্তস্বল্পতার কারণ (cause) নির্ণয়ের জন্য। কারণ নির্ণয়ের পর কারণ ও রক্তস্বল্পতার মাত্রা অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হয়। সাধারণ মানুষের জন্য রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট এ রক্তস্বল্পতার লক্ষণ হল হিমোগ্লোবিন (haemoglobin, Hb) কম পাওয়া।
দু:খের বিষয় হল অনেক শ্রদ্ধেয় চিকিৎসকের মধ্যে এই ধরনের একটি প্রবনতা আছে যে রক্তস্বল্পতা হলেই তাঁরা রোগীকে রক্ত দিয়ে দেন। রক্তস্বল্পতাকে অনেকেই খুব স্বাভাবিক ও কম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় মনে করেন (বিশেষ করে বয়োঃ জ্যেষ্ঠগণের ক্ষেত্রে)। এটি সম্মানিত রক্তরোগ বিশেষজ্ঞগণের মতে মারাত্মক ভুল একটি কাজ। রক্তস্বল্পতার মাত্রা খুব বেশি হয়ে রোগীর জীবন সংকটাপন্ন না হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রক্তস্বল্পতার চিকিৎসায় রক্তের কোন ভূমিকা নেই। বরং রক্তের ভিতর জানা অজানা অনেক এন্টিজেন, এন্টিবডি আর জীবাণু থাকতে পারে যা রোগীর স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী বিভিন্ন ক্ষতি করতে পারে এমনকি মৃত্যুরও কারণ হতে পারে। আর রোগের যথাযথ কারণ নির্ণয় না করে রক্ত দিলে অনেক সময়ই রক্ত দেওয়ার পর উল্টো হিমোগ্লোবিন কমে যেতে পারে। আবার ঘাপটি মেরে থাকা কোন কঠিন রোগ ধরা পড়তে দেরি হতে পারে। যা পরে ধরা পড়লেও ততক্ষণে অনেক রোগ ছড়িয়ে গিয়ে চিকিৎসার বাইরে চলে যায়।
অনেকেই রক্ত কম দেখলেই মাত্রা হিসেব না করেই আয়রন ঔষধ খেতে থাকেন বা আয়রন ইঞ্জেকশন নিতে থাকেন। কিন্তু যে রক্তস্বল্পতা আয়রনের ঘাটতির জন্য হয়নি সেটিতে আয়রনের ঔষধের কোন ভূমিকা নেই। বরং অতিরিক্ত আয়রনের ঔষধ খাওয়ার ফলে হার্ট, লিভার, হরমোন গ্রন্থিতে আয়রন জমে হার্ট ফেইল, ডায়াবেটিস, থাইরয়েড ও প্রজননগত সহ নানান সমস্যা হতে পারে। আয়রন ইঞ্জেকশন অনেক সময়ই হাইপার সেন্সিটিভিটি রিয়েকশন করতে পারে যা প্রাণঘাতি হতে পারে।
তাহলে কি করতে হবে?
চিকিৎসার প্রধান পূর্বশর্ত হল যথাযথ কারণ নির্ণয়। তাই প্রথমেই যথাযথ বিশেষজ্ঞগণের তত্ত্ববধানে রোগীর সমস্যা শুনে, শারীরিক পরীক্ষা করতে হয়। এরপর সংশ্লিষ্ট ল্যাব পরীক্ষা করে রক্তস্বল্পতার মাত্রা, প্রকৃতি আর কারণ নির্ণয় করতে হয়। সঠিকভাবে কারণ ধরা পরলে সাধারণত মুখে খাওয়ার বিভিন্ন ঔষধ দিয়েই রক্তস্বল্পতা ভাল হয়ে যায়। দুঃখজনকভাবে রোগীদের অনেকেই নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে ঔষধ খান না। যার ফলে সমস্যার সমাধান হয় না। অনেক সময় রোগীর অবস্থা বিবেচনা করে শিরাপথে বা চামড়ার নিচে কিছু ইঞ্জেকশন দিতে হয়। এই ঔষধগুলো কখনো কখনো কিছু জটিল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া করে। তাই সম্মানিত চিকিৎসকগণের প্রেসক্রিপশন ব্যতিত এসব ঔষধ দেওয়া প্রাণঘাতি হতে পারে। অল্প কিছু ক্ষেত্রে যেমন ক্যান্সার জাতীয় সমস্যায় দ্রুত অপারেশন বা ক্যান্সারের অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতি নিতে হয়। অসুস্থতা জীবনের অনুষঙ্গ। কিন্তু অসুস্থতাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে এমন কোন কারণ নেই। রক্তস্বল্পতার ক্ষেত্রে এটি চরম এক সত্য। আর যে কোন অসুস্থতায় প্রাথমিকভাবে সঠিক রোগ নির্ণয়ের মাধ্যমে যথাযথ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণের মাধ্যমে চিকিৎসা নিলে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
খুব দুঃখ লাগে যখন একটু অবহেলা, ভুল ব্যাক্তির ভুল পরামর্শ নিরাময় যোগ্য রোগকে প্রাণঘাতি অবস্থায় নিয়ে যায়। আপনি নিজেই বা আপনার বৃদ্ধ বাবা-মা বা স্বামী-স্ত্রী-সন্তান বা আপনজনদের যে কোন সমস্যায় সম্মানিত চিকিৎসকগণের মাধ্যমে দ্রুত চিকিৎসা করুন। আর নয় পথহারা পথিক হয়ে আনন্দ উদ্যম হারিয়ে জীবনের ঘানি টেনে চলা। একটাই জীবন। ভালভাবে সুন্দর সুস্থভাবে বাঁচুন।
Last Updated on 05/04/2020 by Editorial Staff
Comments
প্রাণহীন পথিকের ক্লান্ত পথ চলা: রক্তস্বল্পতা — No Comments
HTML tags allowed in your comment: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>