থ্যালাসেমিয়ার সাত সতেরো : Prevention is better than cure
থ্যালাসেমিয়া কি?
থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রক্তস্বল্পতা জনিত রোগ।
এটি কোন ছোঁয়াচে রোগ নয়। রক্তের ক্যান্সারও নয়।
প্রকারভেদঃ
ক্লিনিক্যালি থ্যালাসেমিয়াকে তিনভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে যেমন থ্যালাসেমিয়া মেজর বা রোগী, মাইনর বা বাহক এবং ইন্টারমিডিয়েট।
থ্যালাসেমিয়ার অনেক প্রকারভেদ আছে যেমনঃ বিটা থ্যালাসেমিয়া, ই বিটা থ্যালাসেমিয়া, হিমোগ্লোবিন ই ডিজিজ, আলফা থ্যালাসেমিয়া, এস বিটা থ্যালাসেমিয়া, হিমোগ্লোবিন এস ডিজিজ, হিমোগ্লোবিন ডি পাঞ্জাব, হিমোগ্লোবিন ডি আরব ইত্যাদি ইত্যাদি।
হেটারোজাইগোস স্টেট অব থ্যালাসেমিয়াকে থ্যালাসেমিয়া বাহক/মাইনর/ট্রেইট বলা হয়।
হোমোজাইগোস স্টেটকে থ্যালাসেমিয়া মেজর বা রোগী বলা হয়।
থ্যালাসেমিয়ার বাহক আর থ্যালাসেমিয়ার রুগী এক কথা নয়।
লক্ষণ কি কি ?
থ্যালাসেমিয়ার বাহক স্বাভাবিক মানুষরূপে বেড়ে ওঠে। তাই কেউ থ্যালাসেমিয়ার বাহক কি না, তা বাহ্যিকভাবে বুঝার কোন উপায় নাই।
আর থ্যালাসেমিয়ার রুগী জন্মের ৬ মাস বয়স হতে ফ্যাকাসে হয়ে যায়, জন্ডিস দেখা দেয়। পেটের প্লীহা ও লিভার বড় হয়ে যায়। ঠিকমতো শরীরের বৃদ্ধি হয় না।
চিকিৎসাঃ
রক্ত স্বল্পতার জন্য প্রতি মাসে ১ থেকে ২ ব্যাগ রক্ত শরীরে নিতে হয়। ঘন ঘন রক্ত নেওয়ায় ও পরিপাক নালী থেকে আয়রনের শোষণ ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় শরীরে আয়রনের মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে লিভার, হৃদপিন্ডসহ অন্যান্য অংগের নানা রকম মারাত্মক জটিলতা দেখা দেয়। সেক্ষেত্রে শরীরের অতিরিক্ত আয়রন কমানোর ঔষধ খেতে হয়।
ইদানিং কিছু ঔষধ ব্যবহার করা হয়ে থাকে যাতে রক্ত কম লাগে।
তবে সঠিক চিকিৎসা ও নিয়মিত রক্ত না নিলে থ্যালাসেমিয়া রুগী মারা যায়।
প্রতিবার রক্ত নেওয়া ও আয়রন কমানোর ঔষধসহ অন্যান্য খরচে একজন থ্যালাসেমিয়া রুগির চিকিৎসায় প্রতিমাসে হাজার টাকার বেশি খরচ হয়।
নিয়মিত রক্ত দিয়ে রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে সঠিক চিকিৎসা করালে থ্যালাসেমিয়া রুগীকে বাচানো সম্ভব হলেও সঠিক চিকিৎসা বোনম্যারু ট্রান্সপ্ল্যান্ট অত্যন্ত ব্যয় বহুল। তাই সবার পক্ষে চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব হয় না।
খাদ্য উপদেশঃ
থ্যালাসেমিয়ার বাহক আর থ্যালাসেমিয়া রুগীর খাবারের উপদেশ এক নয়। থ্যালাসেমিয়ার বাহকের খাবার স্বাভাবিক মানুষের মতো। আয়রন জাতীয় খাবারের নিষেধ নাই বরং আয়রনের ঘাটতি হলে বেশি বেশি আয়রন জাতীয় খাবার খেতে দিতে হয়। আর থ্যালাসেমিয়া রুগীর জন্য আয়রন জাতীয় খাবার কম খেতে হয় এবং প্রয়োজনে শরীর থেকে আয়রন কমানোর ঔষধ দিতে হয় যা ব্যয় বহুল। তবে কোন কারনে আয়রনের ঘাটতি থাকলে অবশ্যই আয়রন জাতীয় খাদ্য ও ঔষধ দিতে হবে।
থ্যালাসেমিয়া রোগ কেন হয় ?
বাবা ও মা দুইজনই থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হলে সন্তান থ্যালাসেমিয়ার রুগী হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
জেনেটিক কি কারণে থ্যালাসেমিয়া হয় ?
লোহিত রক্ত কনিকার মধ্যে হিমোগ্লোবিন ( হিম+ গ্লোবিন) থাকে বিধায় রক্ত লাল দেখায়।
স্বাভাবিক মানুষের লোহিত রক্ত কনিকার গড় আয়ু ১২০ দিন হলেও থ্যালাসেমিয়া রুগীর ত্রুটিপূর্ণ গ্লোবিনের কারনে লোহিত রক্ত কনিকার গড় আয়ু মাত্র ২০ থেকে ৬০ দিন। অপরিপক্ক অবস্থায় লোহিত রক্ত কনিকা ভেংগে যায় বা মারা যায় তাই রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়।
মানব দেহে ২৩ জোড়া বা ৪৬ টি ক্রোমোজোম থাকে। সন্তানের মধ্যে একটি ক্রোমোজম মায়ের আর একটি ক্রোমোজম বাবার থেকে আসে।
১৬ নং ক্রোমোজোমে থাকে আলফা জীন আর ১১ নং ক্রোমোজোমে থাকে বিটা জীন। আলফা ও বিটা জীনদ্বয় আলফা ও বিটা গ্লোবিন নামক প্রোটিন তৈরি করে যা অনেক গুলো এমাইনো এসিডের সমষ্টি। জন্মগতভাবে ১৬ অথবা ১১ নং ক্রোমোজোমের আলফা অথবা বিটা জীন সঠিকভাবে এমাইনো এসিড তৈরি করতে পারে না ফলে আলফা অথবা বিটা গ্লোবিন নামক প্রোটিন ত্রুটিপূর্ণ হয়। আলফা অথবা বিটা গ্লোবিন চেইন ত্রুটিপূর্ণ থাকায় হিমোগ্লোবিন ত্রুটিপূর্ণ হয় বিধায় লোহিত রক্ত কনিকা দ্রুত ভেংগে যায় বা মারা যায় এবং রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়।
বাংলাদেশে সমস্যা কোথায়?
থ্যালাসেমিয়া স্ক্রেনিং প্রোগ্রাম না থাকায়, অনেকেই জানে না তিনি থ্যালাসেমিয়ার বাহক কিনা। তাই অজান্তেই থ্যালাসেমিয়া বাহকের মধ্যে বিয়ে হচ্ছে এবং স্বামী-স্ত্রী দুইজনই বাহক হওয়ার কারণে দিন দিন থ্যালাসেমিয়া রুগি বাড়ছেই।
বাবা-মা উভয়েই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে প্রতিটি সন্তান জন্মদানে থ্যালাসেমিয়া রুগী হওয়ার ঝুঁকি শতকরা ২৫ ভাগ, বাহক হওয়ার ঝুঁকি শতকরা ৫০ ভাগ আর সুস্থ হওয়ার সম্ভবনা শতকরা ২৫ ভাগ।
বাবা-মা যেকোনো একজন থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে প্রতিটি সন্তান জন্মদানে থ্যালাসেমিয়া বাহক হওয়ার ঝুঁকি শতকরা ৫০ ভাগ, সুস্থ হওয়ার সম্ভবনা শতকরা ৫০ ভাগ, তবে থ্যালাসেমিয়া রুগী হওয়ার সম্ভবনা নাই।
চাচাতো, মামাতো, খালাতো, ফুফাতো ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে হলে থ্যালাসেমিয়া রুগী হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
করনীয় কিঃ
১) মা বাবার দুইজনের জীনেই থ্যালাসেমিয়ার বাহক থাকলে সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রুগী হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই দুজন বাহকের মধ্যে বিয়ে না হওয়া বা বন্ধ করা। একজন সুস্থ মানুষ যে কাউকে (বাহক বা রোগীকে) বিয়ে করতে পারবে। কারণ তাদের সন্তান রোগী হওয়ার সম্ভবনা নাই। তবে একজন বাহক আরেকজন বাহককে বিয়ে করতে পারবে না। কারণ সন্তানের রোগী হওয়ার ঝুঁকি আছে।
২) দুইজন থ্যালাসেমিয়া বাহকের মধ্যে যদি বিয়ে হয়েই যায় বা স্বামী স্ত্রী দুই জনই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হয়, তবে বাচ্চা পেটে আসার আট থেকে চৌদ্দ সপ্তাহের মধ্যে ক্রোওনিক ভিলাস স্যাম্পল বা এমনিওসেন্টেসিস করে বাচ্চার অবস্থা জানা যায়। পেটের বাচ্চা থ্যালাসেমিয়ার রুগী হলে কাউন্সিলিং করতে হবে (গর্ভপাত) যাতে একজন নতুন থ্যালাসেমিয়া রুগীর জন্ম না হয়। তবে থ্যালাসেমিয়া বাহক হলে বাচ্চার স্বাভাবিক জন্মদানে অসুবিধা নাই।
তাই বিয়ের আগেই রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে প্রত্যেককে জানতে হবে থ্যালাসেমিয়ার বাহক কিনা।
দুইজন থ্যালাসেমিয়া বাহকের মধ্যে বিয়ে দেওয়া নিরুৎসাহিত করতে হবে যাতে থ্যালাসেমিয়া রুগী মুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা যায়।
দুই জন থ্যালাসেমিয়া বাহকের মধ্যে বিয়ে বন্ধ করা গেলেই থ্যালাসেমিয়া রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
আসুন, নিজের প্রয়োজনেই হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফরেসিস পরীক্ষার মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়ার বাহক কি না জেনে নিই।
কিভাবে জানা যাবে আপনি থ্যালাসেমিয়ার বাহক কি না?
হেমাটোলজি অটো এনালাইজার মেশিনে রক্তের সিবিসি পরীক্ষায় থ্যালাসেমিয়া বাহক এর ধারণা পাওয়া যায়। এরপর হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফরেসিস পরীক্ষা করে থ্যালাসেমিয়া বাহক কিনা নিশ্চিত হওয়া যাবে। তবে, ক্ষেত্রবিশেষ ডিএনএ এনালাইসিস পরীক্ষা করা লাগে।
আরো বংশগত রোগ আছে যা স্বামী স্ত্রীর উভয় পরিবারে থাকলে সন্তানের রোগী হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই সচেতনতার মাধ্যমে প্রতিরোধ করাই উত্তম।
Comments
থ্যালাসেমিয়ার সাত সতেরো : Prevention is better than cure — No Comments
HTML tags allowed in your comment: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>