ডেঙ্গুঃ হেমাটোক্রিট, প্লেটিলেট, ট্রান্সফিউশন
লিখেছেন ডাঃ সুরজীৎ সরকার তিতাস
ডেঙ্গুতে ভাসকুলার লিকেজ হয় ফলে রক্তের প্লাজমা রক্তনালি থেকে বের হয়ে টিস্যু স্পেসে চলে আসে একারণেই রক্তের ঘনত্ব বেড়ে যায় এবং হেমাটোক্রিট বাড়তে থাকে। ডেঙ্গু চিকিৎসার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশই হচ্ছে হেমাটোক্রিট ব্যাবস্থাপনা। ডেঙ্গুতে হেমাটোক্রিট বেড়ে যাওয়া যেমন রোগের জটিলতা সম্পর্কে ধারণা দেয় তেমনি কমে যাওয়াও চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেয়। আমাদের বেশিরভাগ মানুষেরই বেসলাইন হেমাটোক্রিট জানা নেই সেকারনেই জ্বরের শুরুতেই যে পরীক্ষা করা হয় সেটাকেই বেসলাইন ধরা হয়। হেমাটোক্রিট ২০% বেড়ে গেলে প্লাজমা লিকেজ হচ্ছে বলে মনে করা হয়। লিকেজ পিরিয়ড প্রায় ৪৮ ঘন্টা চলতে পারে। এসময় গাইডলাইন অনুযায়ী রোগীকে ফ্লুইড দিতে হবে। হেমাটোক্রিট ৪০% এর নীচে নেমে গেলে রোগীর পালস/ ব্লাড প্রেশার ঠিক থাকলে আইভি ফ্লুইড দেবার প্রয়োজন নেই। কারন তাতে ওভার হাইড্রেশন হতে পারে।
একটা বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন, ডেঙ্গুতে যে প্লাজমা লিকেজ হয় সেটা কিন্তু রিকভারি পর্যায়ে আবার রক্তনালিতে ঢুকে পরে। ডায়রিয়াতে যে পানি শূন্যতার সৃষ্টি হয় তার সাথে ডেঙ্গুর পার্থক্য এখানেই। ডেঙ্গুতে সেকারণেই রিকভারি পর্যায়ে হেমাটোক্রিট কমতে থাকে এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে সেসময় ফ্লুইড এর ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। ডেঙ্গুতে হেমাটোক্রিট কমতে থাকলে তিনটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে – (১) অতিরিক্ত আইভি ফ্লুইড (স্যালাইন), (২) ইন্টারনাল হিমোরেজ(রক্তক্ষরণ) এবং (৩) রিকভারি পর্যায়। হেমাটোক্রিট ৩% কমে গেলে ধারণা করা হয় ৫০০ মিলি রক্ত লস হয়েছে। হেমাটোক্রিট ২৫% এর নিচে নেমে গেলে রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন হতে পারে। তবে তা অতিরিক্ত স্যালাইনের জন্য হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে। সাধারণত রিকভারি পর্যায়ে হেমাটোক্রিট কমলেও তা ২৫% এর নিচে নামে না। ডেঙ্গুতে ফ্লুইড যেমন প্রয়োজন তেমনি এটা ক্ষতির কারণও হতে পারে। কখন কতটা ফ্লুইড দেবেন সেটা নির্ধারণ করতে হবে হেমাটোক্রিট দেখে।
প্লেটিলেট কমে যাওয়া ডেঙ্গুতে একটা সাধারণ ঘটনা। শুধু ডেঙ্গু নয় যে কোন ভাইরাস ইনফেকশনেই প্লেটিলেট কমতে পারে। ডেঙ্গুতে বোনম্যারোতে উৎপাদন কমে যাবার পাশাপাশি ডেঙ্গু ভাইরাস সরাসরি প্লেটিলেট ভেঙে ফেলে, এমনকি শরীরের ইমিউন সিস্টেমের মাধ্যমেও প্লেটিলেট ভেঙে যেতে পারে। সাধারণত তৃতীয় থেকে সপ্তম দিন পর্যন্ত প্লেটিলেট কমতে পারে এরপর আবার বাড়তে শুরু করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্লেটিলেট নিয়ে সবাই ভীত থাকে কিন্তু বাস্তবে খুব নগন্য সংখ্যক রোগীরই প্লেটিলেট প্রয়োজন হয়। প্লেটিলেট ট্রান্সফিশনের সবচেয়ে বড় শর্ত হল রক্তক্ষরণ। রক্তক্ষরণ শুরু হলে তৎক্ষনাৎ প্লেটিলেট দিতে হবে সেক্ষেত্রে প্লেটিলেটের সংখ্যা বিবেচ্য নয়। কারন ডেঙ্গুতে কেবল প্লেটিলেটের সংখ্যাই কমে না বরং অনেক ক্ষেত্রেই এর কার্যক্ষমতাও কমতে পারে। তবে প্লেটিলেট কাউন্ট ১০,০০০ (দশ হাজার) এর নিচে নেমে গেলে প্রোফাইলেকটিক প্লেটিলেটের প্রয়োজন হতে পারে। ডেঙ্গু ব্যাবস্থাপনায় প্লেটিলেটের গুরুত্ব হেমাটোক্রিট এর চেয়ে কম।
অনেকেই প্রশ্ন করেন ডেঙ্গু রোগী রক্ত দিতে পারবেন কিনা। একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন ডেঙ্গু যে কেবল মশার মাধ্যমে ছড়ায় তা নয়। এটা প্রমানিত যে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর রক্তের মাধ্যমেও ডেঙ্গু ছড়াতে পারে। কাজেই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে পরবর্তী ছয় মাস রক্ত না দিতে বলা হয়। যদিও ডেঙ্গু রোগীর রক্ত ভাইরাস থেকে মশার মাধ্যমে জ্বর শুরুর আগের দিন থেকে জ্বরের সপ্তম দিন পর্যন্ত ছড়াতে পারে। সেকারণেই ডেঙ্গু রোগীকে জ্বরের সপ্তম দিন পর্যন্ত মশারির ভিতর থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়।
আমরা সবাই জানি ডেঙ্গুর নির্ধারিত কোন চিকিৎসা নেই। খুব অল্প সংখ্যক রোগীরই জটিলতা হয় তবে কার জটিলতা হবে সেটা নির্ধারন করাও প্রায় অসম্ভব। সেকারণে প্রায় সব রোগীই হাসপাতালে ভর্তি হতে চায়। এর যতটা না প্রয়োজনে তার চেয়ে বেশি ভয়ে। যদিও বলা হয় ক্রস ইনফেকশনে জটিলতা বেশি হয়। ক্রস ইনফেকশন অর্থ পূর্বে ডেঙ্গুর চারটি ভাইরাসের যেকোন একটি দিয়ে ইনফেকশন হয়েছিল এবার অন্য একটি ভাইরাস দিয়ে নতুন করে ইনফেকশন হয়েছে। এটা জানতে হলে NS1Ag এর পাশাপাশি IgG এবং IgM পরীক্ষা করাতে হবে। NS1Ag এবং IgM বর্তমান ইনফেকশন নিশ্চিত করে আর IgG পূর্বের ইনফেকশনকে নির্দেশ করে। কাজেই কোন রোগীর যদি NS1Ag/IgM এর পাশাপাশি IgG পজিটিভ থাকে তবে সেক্ষেত্রে ক্রস ইনফেকশন বিবেচনায় রাখতে হবে এবং অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আর অবশ্যই ডেঙ্গু রোগীর স্যালাইন দেবার ব্যাপারে গাইড লাইন অনুসরণ করা উচিত।
সব সতর্কতা অবলম্বনের পরেও কিছু রোগীর জটিলতা এড়ানো সম্ভব নাও হতে পারে।
Last Updated on 05/04/2020 by Editorial Staff
Comments
ডেঙ্গুঃ হেমাটোক্রিট, প্লেটিলেট, ট্রান্সফিউশন — No Comments
HTML tags allowed in your comment: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>