কোভিড-১৯-এর চিকিৎসায় স্টেম সেল থেরাপি
ডাঃ মোঃ শহীদুল ইসলাম (শোভন)
নোভেল করোনা ভাইরাস সৃষ্ট মহামারীর তান্ডবে ইতোমধ্যে সারাবিশ্বের প্রায় ৯ কোটি মানুষ আক্রান্ত এবং সাড়ে চার লক্ষ প্রাণহানি ঘটেছে। নোভেল করোনা ভাইরাস দ্বারা মানব শরীরে সৃষ্ট রোগের নাম নোভেল করোনা ভাইরাস ডিজিজ বা ‘কোভিড-১৯’। আক্রান্ত ব্যাক্তির মধ্যে সাধারণত জ্বর, সর্দি, শুকনো কাশি, গলাব্যথা, শ্বাসকষ্ট, শরীর/মাংস পেশিতে ব্যথা ইত্যাদি রোগ লক্ষণ হিসাবে প্রকাশ পায়। এখন পর্যন্ত শ্বাসতন্ত্রীয় নমুনার আরটি –পিসিআর RT-PCR (রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেজ-পলিমারেজ চেইন রিএ্যাকশন) পদ্ধতিটিই এই রোগ সনাক্তকরনের আদর্শ পদ্ধতি হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। যদিও দ্রুত রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতি হিসোবে এন্টিজেন ও এন্টিবডি টেস্টিং কিট নিয়ে বাংলাদেশ সহ সারাবিশ্বে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা চলছে।
নতুন এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো ভ্যাক্সিন বা ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। বেশ কিছু দেশ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান এই ভাইরাসের ভ্যাক্সিন আবিস্কারের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এদের মধ্যে আমেরিকার মর্ডানা (Moderna Inc.),ইউকে’র এস্ট্রাজেনেকা (AstaZeneca), চায়না’র সিনোভাক (Sinovac), জার্মানির ফাইজার (Pfizer) ও কিউরভাক (CureVac) এবং রাশিয়ার গামায়েলা রিসার্চ ইনস্টটিউট (Gamaleya research institute) এর ভাষ্য অনুযায়ী চলতি বছরের শেষের দিকে ভ্যাক্সিন ব্যবহার উপযোগী হবে বলে আশা প্রকাশ করেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সয়স্থা মতে, কোভিড-১৯ আক্রান্তদের মধ্যে অন্তত শতকরা ৮০ ভাগ রোগীই মৃদু উপসর্গ প্রকাশ করে এবং স্বতঃস্ফুর্ত ভাবেই সুস্থতা অর্জন করেন। বাকি ২০ ভাগের মধ্যে শতকরা ১৪ ভাগ রোগী ‘মারাত্মক রোগের পর্যায়ে’ (Severe disease)’ এবং ৬ ভাগ রোগী ‘সংকটাপন্ন অবস্থা’ (Critically ill)’ হিসেবে হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা করার প্রয়োজন হয়। আক্রান্ত রোগীর দেহ থেকে এই ভাইরাস নির্মূলের জন্য এখনও পর্যন্ত স্বীকৃতি কোন এন্টিভাইরাল ওষুধ আবিস্কৃত হয়নি। তবে ইতিপূর্বে অন্যরোগের জন্য আবিস্কৃত কিছু ওষুধ (Repurpose use) (যেমনঃ রেমডেসেভির, ফাভিপিরাপির, ক্লোরোকুইন/হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন, আইভারমেকটিন ইত্যাদি) ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে। বেশ কিছু দেশ ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই এই ওষুধের কার্যকারিতা নির্ণয়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালনা করছে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রত্যাশিত ফলাফল মিলছে না।
নোভেল করোনা ভাইরাসের সংক্রমনে মৃত্যুর প্রধান কারণ ভাইরাস নিজে নয়, বরং ভাইরাসের বিরুদ্ধে চ্যালেন্জ করা আমাদের দেহের ইম্যিউন সিস্টেম (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা)‘র অতি সংবেদনশীলতা। নোভেল করোনা ভাইরাস শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে ফুসফুসের কোষে প্রবেশ করার পর ভাইরাসের বংশবৃদ্ধির ফলে সংশ্লিস্ট কোষটি পাইরোপটোসিস (Pyroptosis) দশায় পরিণত হয় যা শক্তিশালী প্রদাহ সৃষ্টিকারী হিসাবে বিবেচিত। এর প্রভাবে ফুসফুসের এপিথেলিয়াল সেল, এন্ডোথেলিয়াল সেল এবং এলভিওলার ম্যাক্রোফেইজ থেকে প্রদাহ সৃষ্টিকারী বিভিন্ন প্রকার জৈব-রাসায়নিক পদার্থ (সাইটোকাইন ও কেমোকাইন) নিঃসৃত হয়। এদের প্রভাবে উৎপত্তিস্থলের প্রতি প্রচুর পরিমাণে রক্তে উপস্থিত মনোসাইট, ম্যাক্রোসাইট ও লিম্ফোসাইট আকৃষ্ট হয় এবং অধিকতর সাইটোকাইন ও কেমোকাইন নিঃসরণ ঘটে। একে সাইটোকাইন স্টর্ম (Cytokine storm) হয় যা ফুসফুসের অবকাঠামো ধ্বংস করাসহ অন্যান্য অংগের (multi-organ damage) ক্ষতিসাধন করে। সাধারণত সাইটোকাইন স্টর্ম নির্ণয়ে সিরাম ফেরিটিন লেভেল পরিমাপ করা হয়। এই সংকটকালীন দশাকে প্রশমন করার জন্য নির্দিষ্টভাবে অনুমোদিত কোন ওষুধ নেই। প্রথাগত কর্টিকোস্টেরয়েড (যেমনঃ সম্প্রতি সুপারিশকৃত ডেক্সামেথাসন) এই সাইটোকাইন স্টর্ম প্রশমিত করার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে যদিও এর ব্যবহার ও কার্যকারিতা ক্ষেত্র বিশেষে বিতর্কিত। সম্প্রতি বিভিন্ন ইন্টারলিউকিন ব্লকার যেমনঃ anakinra (IL-1 ব্লকার), tocilizumab (IL-6 receptor ব্লকার), এবং Janus kinase (JAK) ইনহিবিটর নভেল করোনা ভাইরাস-সৃষ্ট অতি সংবেদনশীলতা প্রশমনে গবেষণাধীন রয়েছে।
স্টেম সেল থেরাপি ইম্যিউন সম্পর্কিত ডিসঅর্ডারে বিস্ময়কর সমাধান হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। বিশেষত আম্বিলিক্যাল কর্ড-ডিরাইভড মেসেনকাইমাল স্টেম সেল (বাচ্চা জন্মের পর গর্ভফুল থেকে প্রাপ্ত) কোভিড-১৯ এর সিভিয়ার নিউমোনিয়ায় সাইটোকাইন স্টর্ম প্রশমন ও নস্ট হয়ে যাওয়া ফুসফুসের মেরামতে চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। মেসেনকাইমাল স্টেম সেল ও বিভিন্ন ইম্যিউন সেল এর সেল-টু-সেল ইন্টারএ্যাকশন এবং প্যারাক্রাইন ইফেক্ট দ্বারা ওভারএ্যাকটিভ ইম্যিউন সিস্টেমকে সাপ্রেশন ও শক্তিশালী ইম্যিউনো-মডুলেশনের মাধ্যমে প্রশমন করতে পারে। বেইজিং ইউএ্যান হাসপাতালে ৭ জন বিভিন্ন পর্যায়ের সিভিয়ার নিউমোনিয়া আক্রান্ত রোগী নেয়া হয় যাদের স্ট্যান্ডার্ড চিকিৎসা চলাকালেও শারিরিক অবস্থা ক্রমাবনতির দিকে যাচ্ছিলো। তাদের প্রত্যেককে শিরাপথে মেসেনকাইমাল স্টেম সেল দেয়া হয়। তারা ২-৪ দিনের মধ্যেই কোন প্রকার অপ্রীতিকর সাইড-ইফেক্ট ব্যতিরেকেই করোনার উপসর্গ মুক্ত হয়েছেন। বিং লিয়াং ও তাঁর দল বুশান পিপলস’ হাসপাতালে ৬৫ বৎসর বয়স্ক কোভিড-১৯ সিভিয়ার নিউমোনিয়াসহ ইলেক্ট্রোলাইট ইমব্যালেন্স এ আক্রান্ত একজন ভদ্রমহিলাকে শিরাপথে আম্বিলিক্যাল কর্ড ডিরাইভড মেসেনকাইমাল স্টেম সেল দ্বারা চিকিৎসা করাতে পরবর্তী দিন থেকেই তাঁর উপসর্গ কমতে থাকে এবং ইলেক্ট্রোলাইট প্যারামিটার স্বাভাবিক হতে শুরু করে। এ যাবৎকাল অবধি মেসেনকাইমাল স্টেমসেল দ্বারা কোভিড-১৯ জনিত সিভিয়ার নিউমোনিয়া চিকিৎসায় রেজিস্ট্রিকৃত চীন, ইরান, যুক্তরাস্ট্রসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে পয়ত্রিশের অধিক ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলমান আছে, যার মধ্যে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রে তিনটি ফেইজ-২/৩ ট্রায়াল রয়েছে।
সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত রিজেনারেটিভ মেডিসিন কোম্পানি মেসোব্লাস্ট (Mesoblast) একটি গবেষণায় নোভেল করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ভেন্টিলেটর সাপোর্টেড রোগীদের শিরাপথে Remestemcel-L (মেসেনকাইমাল স্টেমসেল) দ্বারা চিকিৎসায় ৮৩% ক্ষেত্রে সফলতা পেয়েছে। যুক্তরাস্ট্রে স্বনামধন্য বায়োফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি Athersys এবং ইউনিভার্সিটি হসপিটাল ক্লিভল্যান্ড মেডিকেল সেন্টার যৌথভাবে কোভিড-১৯ সিভিয়ার ডিজিজে আক্রান্ত রোগীদের উপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ইতোমধ্যে শুরু করেছে। বৈশ্বিক মহামারী মোকাবেলায় স্টেম সেল থেরাপী অচিরেই উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে বলে বিজ্ঞানীগণ দৃঢ়ভাবে আশাবাদী।
Last Updated on 23/07/2020 by Editorial Staff
Comments
কোভিড-১৯-এর চিকিৎসায় স্টেম সেল থেরাপি — No Comments
HTML tags allowed in your comment: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>