ব্লাড ক্যান্সার বা লিউকেমিয়া
লিখেছেন ডাঃ মোহাম্মদ কামরুজ্জামান
ব্লাড ক্যান্সার বা লিউকেমিয়া কি ও কেন হয়?
ব্লাড ক্যান্সার কোনো বংশগত বা ছোয়াচে রোগ নয়। এর প্রকৃত কারণ জানা নাই। তবে রেডিয়েশন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিকেল, পেস্টিসাইড, ভেজাল খাবার, হেয়ার ডাই, লুব্রিকেন্টস, বার্ণিশ, কেমোথেরাপি ড্রাগস ও কিছু জেনিটিক অসুখ দায়ী থাকতে পারে। উপরোক্ত যে কোন কারনে অস্থিমজ্জার ভিতরের স্টিমসেল বা রক্তের অপরিপক্কসেলের মিউটেশন বা অন্য কোনো পরিবর্তন হলে ক্যান্সার সেল বা ব্লাস্ট তৈরি হয় যা অস্থিমজ্জার ভিতরে অতিদ্রুত বৃদ্ধি হয়।
ব্লাড ক্যান্সারের উপসর্গ গুলো কি এবং কেন হয়?
দূর্বলতা, খাবারে অরুচি, বুকে ধড়পড়, ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া, ঘন ঘন ইনফেকশন বা জ্বর, গায়ে কালে কালো দাগ ও রক্তক্ষরণ, গায়ে ব্যাথা, গ্লাড ফুলে যাওয়া, প্লীহা ও লিভার বড় হওয়া ব্লাড ক্যান্সার বা লিউকেমিয়ার লক্ষণ। ক্যান্সার সেল বা ব্লাস্টের সংখ্যা এত বেশি বেড়ে যায় যে অস্থিমজ্জার ভিতরে স্বাভাবিক সেল যেমন লোহিত রক্তকনিকা, স্বেত রক্তকনিকা ও অণুচক্রিকা বৃদ্ধি হওয়ার মতো জায়গা পায় না। ফলে ক্যান্সার সেল ছাড়া অন্য সুস্থ সেলগুলো পরিমান মতো তৈরি হতে পারে না। অস্থিমজ্জার ভিতরে লোহিত রক্ত কনিকার ঘাটতিতে রক্তস্বল্পতা, অস্বাভাবিক স্বেত রক্ত কনিকার কারনে ইনফেকশন বা জ্বর এবং অণুচক্রিকার ঘাটতিতে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। এক সময় অস্থিমজ্জার ভিতর ক্যান্সার সেল বা ব্লাস্ট এত বেশি বেড়ে যায় যে অস্থিমজ্জার ধারণক্ষমতার বাহিরে চলে যায়। ফলে হাড্ডির ভিতর প্রচন্ড ব্যাথা শুরু হয়। এক পর্যায়ে ক্যান্সার সেল বা ব্লাস্ট অস্থিমজ্জা থেকে বের হয়ে শিরার রক্তে চলে আসে।
ব্লাড ক্যান্সারের প্রকারভেদ ও চিকিৎসাঃ
ব্লাডক্যান্সার বা লিউকেমিয়া মুলত: দুই ধরনের। একিউট লিউকেমিয়া ও ক্রনিক লিউকেমিয়া। একিউট লিউকেমিয়া খুবই মারাত্মক। দ্রুত চিকিৎসা না নিলে মৃত্যু নিশ্চিত। একিউট লিউকেমিয়া আবার দুই ধরনের যথা ১) একিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া বা এএলএল এবং ২) একিউট মায়েলোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া বা এএমএল।
কি ধরনের কেমোথেরাপি দিতে হবে এবং ফলাফল কি হবে তা জানার জন্য একিউট লিউকেমিয়াকে পরীক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন উপভাগে ভাগ করা হয়। যে প্রকারেরই একিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া বা এএলএল হোক না কেন, চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং দীর্ঘমেয়াদি। শুধু কেমোথেরাপি দিয়ে চিকিৎসা করলে দুই থেকে আড়াই বছর চিকিৎসা নিতে হয়। কারো কারো দ্রুত বোনম্যারু ট্রান্সপ্লান্টেশন বা অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করতে হয়।
একিউট মায়েলোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া বা এএমএল মূলত আট প্রকারের যেমন: এম-০,১,২,৩,৪,৫,৬ ও ৭। এএমএল এম-২,৪ কে শুধু কেমোথেরাপি দিয়ে টানা ৪ মাস চিকিৎসা করলে ভাল হওয়ার সম্ভবনা অনেক। এম-৩ বা এপিএল নামক ব্লাড ক্যান্সারকে শুধু কেমোথেরাপি দিয়ে টানা দুই বছর চিকিৎসা করলে সম্পুর্ন সুস্থ হওয়ার সম্ভবনা শতকরা ৮০ ভাগের বেশি। এম-২, ৩ ও ৪ ছাড়া বাকী এএমএল নামক ব্লাড ক্যান্সার গুলোর বিএমটি বা অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন ছাড়া কার্যকর কোন চিকিৎসা নাই।
ক্রনিক লিউকেমিয়ারও প্রকারভেদ আছে। চিকিৎসার ধরণও ভিন্ন ভিন্ন। ক্রনিক লিউকেমিয়ার রুগী সঠিক চিকিৎসা নিয়ে অনেকদিন ভালোভাবে জীবন যাপন করতে পারে। মলিকিউলার টার্গেটেড থেরাপি আবিষ্কার হওয়ায় অনেক ক্যান্সার কিউর হয়। ক্রনিক মায়েলোয়েড লিউকেমিয়া বা সিএমএল তারমধ্যে অন্যতম। তবে কেমোথেরাপি দিয়ে চিকিৎসা করার পর দীর্ঘদিন ফলো আপে থাকা বাঞ্ছনীয়।
যেকোনো ব্লাড ক্যান্সার বা লিউকেমিয়ার ক্ষেত্রে কেমোথেরাপি কাজ না করলে বা রোগ ফিরে আসলে এইচএলএ টিসু ম্যাচিং ডোনার থেকে স্টিমসেল বা অস্থিমজ্জা সংগ্রহ করে বোনম্যারু ট্রান্সপ্লান্টেশন বা অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করতে হয়। ২০১৪ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশে সর্ব প্রথম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীর অস্থিমজ্জা রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপন (অটোলোগাস বিএমটি) করে মায়েলোমা ও লিম্ফোমা নামক ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসা শুরু হয় এবং এ পর্যন্ত সফলতার হার শতভাগ। পরবর্তীতে এপোলো হাসপাতাল ও সিএমএইচ ঢাকায় এ চিকিৎসা শুরু করেছে। লিউকেমিয়া, থ্যালাসেমিয়া, এপ্লাস্টিক এনেমিয়া নামক মরনব্যাধির সর্বশেষ চিকিৎসা ডোনারের অস্থিমজ্জা রোগীকে প্রতিস্থাপন (এলোজেনিক বিএমটি) বাংলাদেশের ঢাকা সিএমএইচ এ শুরু করেছে।
ক্যান্সার চিকিৎসার চেয়ে ক্যান্সার প্রতিরোধ ও দ্রুত রোগ নির্ণয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। জন সচেতনতার মাধ্যমে প্রতিরোধ ও দ্রুত রোগ নির্ণয় হলে চিকিৎসার ফলাফল ভালো হয় এবং সম্পূর্ণ সুস্থ হতে পারে। বিশ্ব ক্যান্সার দিবসে (০৪/০২/১৯) সকলের জন্য শুভ কামনা!
ডাঃ মোহাম্মদ কামরুজ্জামান, সহকারী অধ্যাপক, হেমাটোলজি বিভাগ ও বিএমটি ইউনিট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
Last Updated on 05/04/2020 by Editorial Staff
Comments
ব্লাড ক্যান্সার বা লিউকেমিয়া — No Comments
HTML tags allowed in your comment: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>