বিশ্ব কর্ড ব্লাড দিবস ২০২২
১৫ই নভেম্বর। বিশ্ব কর্ড ব্লাড দিবস। বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় বিশ্ব প্রতিদিন নতুন নতুন জিনিষ দেখছে এবং নতুন নতুন বিষয় জানছে। তেমনি চিকিৎসা বিজ্ঞানেও নতুন নতুন পদ্ধতি আসছে। আর চিকিৎসা বিজ্ঞান হলো মানুষের বাচা মরার লড়াইয়ের বিজ্ঞান। আজরাইলের সাথে যুদ্ধ করার বিজ্ঞান। দেহে মনে সুস্থ থাকার বিজ্ঞান।
আপনারা জানেন যে একসময় আমাদের দেশে গোবরকে সার হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এখন গোবর থেকে এখন গ্যাস উৎপন্ন হচ্ছে এই আমাদেরই দেশে। আবার আবর্জনা থেকেও গ্যাস উৎপন্ন হয়। আর সেই গ্যাস রান্নার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। একটা সময় আশ্চর্য হতাম, আমরা চিন্তাও করতে পারতাম না যে নোংরা আবর্জনা আমাদের কাজে লাগতে পারে। আজ আমি আপনাদেরকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের এমন একটি গল্প শোনাবো। নোংরা আবর্জনা থেকে আমরা নতুন প্রাণের সৃষ্টি করতে পারি। মানুষের মানুষকে ফেলে দেওয়া আবর্জনাকে কাজে লাগিয়ে আমরা মানুষকে নতুন জীবন দিতে পারি। সেই গল্প শোনাবো।
আপনারা ব্লাড ক্যান্সারের নাম শুনেছেন। রক্তে যে সমস্ত কোষ থাকে তার ক্যান্সার। শুনলেই পিলে চমকে যাওয়ার মতো অবস্থা। একটা সময় এর কোন চিকিৎসা হতোনা। ব্লাড ক্যান্সার মানেই মৃত্যু। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞান আজ একে জয় করে ফেলেছে। অনেক ব্লাড ক্যান্সার শুধুমাত্র কেমোথেরাপি দিয়েই ভালো হয়। আমাদের দেশে তা নিয়মিতই করা হচ্ছে। তবে কিছু কিছু ব্লাড ক্যান্সার শুধুমাত্র কেমোথেরাপিতে ভালো হয়না। সেসবের জন্য বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট বা স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্ট নামক চিকিৎসা দিয়ে নিরাময় করা হয়।
প্রশ্ন হলো স্টেম সেল কী?
এই যে আমাদের শরীর। এতে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কোষ বা সেল থাকে। এতো এতো সেল একটি মাত্র সেল থেকে তৈরী হয়। শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর একীভূত হওয়ার ফলে যে কোষ তৈরী হয় তাকে জাইগোট বলে। এই জাইগোট একটি থেকে দুটি, দুটি থেকে চারটি … এরকম অসংখ্য সেল তৈরী হয়। সেলগুলো বিকশিত ও পরিপক্ক হয়ে বিভিন্ন প্রকার সেল তৈরী হয়। যেমন, হাড়, মাংস, স্নায়ু, রক্ত ইত্যাদি। যেই সমস্ত আদি সেল থেকে বিভিন্ন প্রকার সেল তৈরী হতে পারে তাকেই স্টেম সেল বলে। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সারা জীবন এরকম অল্প সংখ্যক স্টেম সেল থাকে। এদের কাজ হলো নতুন নতুন কোষ তৈরী করা। শরীরের কোথাও কোন সেল বা টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হলে এই স্টেম সেল থেকে সেখানকার ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলো মেরামত করার বিশেষ ব্যবস্থা সৃষ্টিকর্তা প্রতিটি প্রাণীর শরীরে দিয়ে রেখেছেন।
ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসার একটি বিশেষ পদ্ধতি হলো আক্রান্ত ক্যান্সারের কোষগুলোকে উচ্চমাত্রার কেমোথেরাপি দিয়ে ধ্বংস করে ফেলা। এই ধ্বংস প্রক্রিয়ায় শরীরের সুস্থ কোষগুলোও ধ্বংস হয়। তখন স্টেম সেল বিশেষভাবে সংগ্রহ করে রোগীর শরীরে প্রবিষ্ট করানো হয়। এই সমস্ত স্টেম সেল থেকে নতুন নতুন কোষ তৈরী হয়। নতুন রক্ত তৈরী হয়। রোগী নতুন জীবন ফিরে পায়।
শুধু যে ব্লাড ক্যান্সার তাইই নয়। আরও অনেক প্রাণঘাতী রোগ স্টেম সেল চিকিৎসায় নিরাময় করা সম্ভব। এদের মধ্যে আছে থ্যালাসেমিয়া। আপনারা অনেকেই থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে ইতিমধ্যে অবগত আছেন। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটি প্রায়ই আলোচিত হচ্ছে। আমাদের সরকারও থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। থ্যালাসেমিয়া একটি জন্মগত ও বংশগত রোগ। নিয়মিত অন্যের রক্ত গ্রহণই আমাদের দেশে এর সাধারণ চিকিৎসা। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীর পরিবারই জানে তাদের অসহায়ত্ব ও অশান্তি। এই থ্যালাসেমিয়ার একমাত্র নিরাময়ী চিকিৎসা হলো স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্ট বা বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট।
আরও আছে। এমন কিছু রোগ আছে যার একমাত্র চিকিৎসা স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্ট। বাচ্চাদের জন্মগত কিছু রোগ আছে যার প্রধান লক্ষণই হলো খুব সামান্যতেই রোগ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হওয়া। প্রাইমারি ইম্যুন ডিফিসিয়েন্সি ডিজিজ বলা হয়। এছাড়াও আছে ফ্যাংকনি এনিমিয়া, অস্টিওপেট্রসিস, জন্মগত প্লেটলেটের সমস্যা ইত্যাদি। সুস্থ মানুষের কাছ থেকে স্টেম সেল সংগ্রহ করে এই সমস্ত আক্রান্ত বাচ্চার শরীরে প্রতিস্থাপন করাই এর একমাত্র নিরাময়ী চিকিৎসা।
ইদানীং রিজেনারেটিভ মেডিসিন নামে চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি নতুন শাখা তৈরী হয়েছে। মানুষের বয়স বাড়ার সাথে সাথে বা যেকোন আঘাত বা গুরুতর অসুখে শরীরের অনেক অঙ্গ দুর্বল হয়ে পরে। যেমন, অস্টিওআর্থ্রাইটিস। শরীরের বিভিন্ন জয়েন্ট ক্ষয় হয়ে দুর্বল হয়ে যায়। ব্যাথা হয়। ব্যাথার কারণে অনেক সময় পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়। স্টেম সেল চিকিৎসা করে এসব ক্ষয়ে যাওয়া জয়েন্টে নতুন প্রাণের সঞ্চার করা যেতে পারে। লিভার সিরোসিসে লিভারের কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। লিভার শুকিয়ে যায়। লিভার সেল বলে যাকে তা কমে যায় এবং লিভারের নানা রকম জটিলতায় একসময় রোগী মারা যায়। স্ট্রোকে ব্রেইনের টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হার্ট এটাকে হার্টের টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়াও পারকিসন ডিজিজ, আলঝেইমার ইত্যাদি। এই সমস্ত রোগের চিকিৎসার জন্য বর্তমানে বিভিন্ন দেশের রিসার্চে স্টেম সেল চিকিৎসা এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।
তাহলে আমরা জানলাম স্টেম সেল কী, কি কি রোগে এর ব্যবহার হয়। এখন আমরা জানতে চাই স্টেম সেল কিভাবে সংগ্রহ করা যায় বা কোথায় পাওয়া যায়।
আগেই জেনেছি যে মানুষের শরীরে খুবই সামান্য পরিমাণ স্টেম সেল থাকে এবং তা সারাজীবন থাকে। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে এই স্টেম সেল থাকে। কিন্তু সহজে পাওয়া যায় বা সহজে সংগ্রহ করা যায় এমন দুটি উৎসের একটি হলো বোন ম্যারো। অর্থাৎ মানুষের রক্ত তৈরী হয় যেখানে তা হচ্ছে অস্থিমজ্জা। অস্থিমজ্জা থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় স্টেম সেল সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু এটি একটি জটিল পদ্ধতি। আরেকটি উৎস হচ্ছে রক্ত। স্বাভাবিক অবস্থায় রক্তে খুবই সামান্য পরিমাণে স্টেম সেল থাকে। বিশেষ ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে এই স্টেম সেলের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়া যায়। এর পর এফেরেসিস প্রক্রিয়ায় দাতার শরীর থেকে তা সংগ্রহ করা হয়। এফেরেসিস হলো একটি বিশেষ প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে দাতার রক্ত এক দিক থেকে মেশিনের মধ্যে প্রবেশ করানো হয়। মেশিন স্টেম সেলগুলো বাছাই করে আলাদা করে নিয়ে বাকি রক্ত ফেরত দেয় এবং তা অন্য টিউব দিয়ে দাতার শরীরে পুনপ্রবিষ্ট করানো হয়। বিষয়টা অনেকটা কিডনি ডায়ালাইসিসের মতো।
এই দুটি প্রক্রিয়াতে যে স্টেম সেল সংগ্রহ করা হয় তাতে স্টেম সেল ছাড়াও অন্যান্য কোষ থাকে, বিশেষ করে শ্বেত কণিকা। দাতার শ্বেত কণিকা অনেক সময় গ্রহীতার শরীরে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। একে গ্রাফট ভার্সাস হোস্ট ডিজিজ বলা হয়। এ কারণে দাতা ও গ্রহীতার টিস্যু ম্যাচিং করা হয়। অর্থাৎ বিশেষ পরীক্ষার মাধ্যমে দাতা ও গ্রহীতার টিস্যু টাইপিং করা হয়। একই টিস্যু হলে অর্থাৎ টিস্যু ম্যাচিং হলেই কেবল মাত্র দাতা নির্বাচন করা হয় এবং ঐ দাতা থেকে স্টেম সেল সংগ্রহ করে ট্রান্সপ্লান্ট চিকিৎসা করা হয়। এধরণের টিস্যু ম্যাচিং ভাই-বোনদের মধ্য থেকে নেয়া উত্তম। কারণ তাতে গ্রাফট ভার্সাস হোস্ট ডিজিজ হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে এবং ট্রান্সপ্লান্ট সফলতার হার বেশী থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো মাত্র ২৫-৩০% ক্ষেত্রে ভাইবোনদের মধ্যে টিস্যু ম্যাচিং হয়ে থাকে। আমাদের দেশে এখনকার পরিবারগুলো ছোট। অনেক সময় রোগীর কোন ভাই-বোন থাকে না, মানে বাবা-মার একমাত্র সন্তান হয়ে থাকে। ফলে স্টেম সেল সংগ্রহের জন্য অনাত্মীয় খুঁজতে হয়। অনাত্মীয় দাতা খুঁজে পাওয়া একটি জটিল প্রক্রিয়া। অনাত্মীয় স্টেম সেল সংগ্রহের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্টেম সেল ডোনার রেজিস্ট্রি আছে। তারা প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে দাতা খুঁজে দেয়। আমাদের দেশে এরকম কোন স্টেম সেল ডোনার রেজিস্ট্রি নাই। কিন্তু এটি একটি অত্যন্ত জটিল ও ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। উপরন্ত অনাত্মীয় দাতার স্টেম সেলে গ্রাফট ভার্সাস হোস্ট ডিজিজ সহ অন্যান্য জটিলতা খুব বেশী হয়।
এই সমস্যা সমাধানের আরেকটি বিকল্প আছে যা আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয়। প্রতিদিন অসংখ্য শিশুর জন্ম হচ্ছে। হাসপাতাল, ক্লিনিক বা বাড়িতে। জন্মের সময় নবজাতকের নাভিতে যে টিউব বা দড়ির মত অঙ্গটি লাগানো থাকে তাকে আমরা আমব্লিকাল কর্ড বলি। এই আমব্লিকাল কর্ড একদিকে শিশুর নাভীতে আর অন্য প্রান্তে জরায়ুর প্লাসেন্টার সাথে লাগানো থাকে। এর মাধ্যমে শিশু গর্ভাকালীন সময়ে প্রয়োজনীয় পুষ্টি মায়ের শরীর থেকে পায়। জন্মের সময় নবজাতকের শরীরে সামান্য একটু অংশ রেখে বাকি পুরো কর্ডটি প্লাসেন্টা সহ ফেলে দেয়া হয়। অথচ আমরা জানিনা এই ফেলে দেয়া অপ্রয়োজনীয় অংশে কি মহামূল্যবান বস্তু রয়েছে। কর্ডের ভিতরে থাকে রক্তনালী। আর এই রক্তনালীতে যে সামান্য পরিমাণ রক্ত থাকে তাতে থাকে অবিশ্বাস্য পরিমাণ স্টেম সেল। এই স্টেম সেল তথা আমব্লিকাল কর্ডের এই সামান্য রক্ত সংগ্রহ করে আমরা কত রোগীর অসামান্য প্রাণ বাচাতে পারি। কত মানুষকে সুস্থ্য করে তুলতে পারি। অনাত্মীয় স্টেম সেল সংগ্রহ ও তার যে পরিমাণ প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা লাগে, তার থেকে অনেক কম পরীক্ষার প্রয়োজন হয়। উপরন্ত অনাত্মীয় স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টের মতো জটিলতাও কম হয়ে থাকে। আমরা এই রক্ত সংগ্রহ করে বছরের পর বছর সংরক্ষণ করতে পারি এবং প্রয়োজনের সময় রোগীর চিকিৎসা কাজে ব্যবহার করতে পারি। আমরা হয়তো স্টেম সেল ডোনার রেজিস্ট্রি তৈরী করতে পারিনি। কিন্তু খুব সহজেই কর্ডব্লাড ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে পারি। এজন্য আমাদের চাই শুধু এবিষয়ে কিছু জানা, একটু সচেতনতা আর সদিচ্ছা। জাতি হিসেবে আমরা একটি ফুলকে বাঁচাতে গিয়ে যুদ্ধ করি, একটি মুখের হাসির জন্য যুদ্ধ করি। আমরা পাথরে ফুল ফোটাই ভালোবাসা দিয়ে। কাজেই আমরা আবর্জনা থেকে মানুষকে নতুন জীবন দিতে পারি একটু সদিচ্ছা দিয়ে। আসুন আমরা সকলেই অংশগ্রহণ করি, অঙ্গিকার করি আমব্লিকাল কর্ড ব্লাড ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় অংশ নিই।
ভাবছেন এই রক্ত কিভাবে সংগ্রহ করা হবে। একসময় এই সংগ্রহ ও সংরক্ষণ প্রক্রিয়া আমাদের দেশে ছিলনা। সম্প্রতি বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এই কাজে এগিয়ে এসেছে। গর্ভাবস্থায় নিবন্ধন করে রাখলে বাচ্চার জন্মের সময় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় উপকরণ সহ হাজির হবে।
Last Updated on 19/11/2022 by Kamrul Hasan
Comments
বিশ্ব কর্ড ব্লাড দিবস ২০২২ — No Comments
HTML tags allowed in your comment: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>