বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ কর্মসূচীর বিষয়ে প্রস্তাবনা
লিখেছেন ডাঃ মোঃ কামরুল হাসান
বিগত ২১/০৬/২০১৭ তারিখটি সম্ভবত বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ আন্দোলনের ইতিহাসে একটি মাইলফলক তারিখ হয়ে থাকবে। কারণ ঐ দিন বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব পাবলিক হেলথে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশে সরকারী উদ্যোগে প্রথমবারের মত থ্যালাসেমিয়া বিষয়ক আলোচনা সভা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বর্তমান সুযোগ্য মহাপরিচালক জনাব ডাঃ আবুল কালাম আজাদ এই সভার আয়োজন করেন ও এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সাথে মতবিনিময় করেন। তার অতীত কর্মজীবনের সাফল্য গাঁথার দিকে ইঙ্গিত করে অনেকেই আশাবাদী হয়েছেন যে, এবার হয়তো থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ আন্দোলন একটি সফল বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে। উক্ত আলোচনা সভায় হেমাটলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন, আইসিডিডিআরবি, ideSHi, সন্ধানী ও মেডিসিন ক্লাবের প্রতিনিধিবৃন্দ সহ হেমাটোলজি, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন, প্রসূতি বিশেষজ্ঞ এবং অনলাইন এক্টিভিস্টগন অংশ গ্রহণ করেন।
কেন থ্যালাসেমিয়া বিষয়ক আলোচনা?
অনেকেই হয়ত ভাববেন যে হঠাৎ করে কেন থ্যালাসেমিয়া নিয়ে মাতামাতি। বিষয়টা আসলে হঠাৎ নয়। থ্যালাসেমিয়া বাংলাদেশে অতীতেও ছিল, বর্তমানেও আছে। বাংলাদেশ পৃথিবীর থ্যালাসেমিয়া বেল্টে অবস্থিত একটি জনবহুল দেশ। একটি দেশের স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মসূচী নির্ধারিত হয় সে দেশের ডিজিজ প্যাটার্ন ও বার্ডেনের উপর। মাত্র কিছু আগে দিন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মসূচী ছিল সংক্রামক ব্যাধি কেন্দ্রিক। কারণ এদেশে সংক্রামক ব্যাধিতে প্রচুর শিশু প্রতি বছর মারা যেত। সরকারের বাস্তবমুখী কর্মসূচীর কারণে সংক্রামক ব্যাধিতে মৃত্যুর হার এখন অনেক কমে গেছে। ফলে আগে থেকে অস্তিত্বশীল অসংক্রামক ব্যাধিগুলো এখন ক্রমান্বয়ে দৃশ্যমান হচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে গড় আয়ু বৃদ্ধির ফলে অনেক অসংক্রামক ব্যাধির প্রকোপ বেড়েছে। এমনকি বর্তমানে এদেশের মানুষের শতকরা ৫৯ ভাগ মৃত্যুর কারণ অসংক্রামক ব্যাধি। থ্যালাসেমিয়া এমনই একটি অসংক্রামক ব্যাধি যা বংশ পরম্পরায় প্রবাহিত হয়। শুনে আশ্চর্য হবেন যে এদেশে প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ থ্যালাসেমিয়ার জিন বহন করে এবং তা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। প্রতি বছর প্রায় ১৫ হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়ার জিন নিয়ে জন্ম নিচ্ছে, যার মধ্য অনুমিত ২৫০০ শিশু থ্যালাসেমিয়া মেজরে আক্রান্ত থাকে। থ্যালাসেমিয়া মেজর অর্থ হল ঐ সমস্ত থ্যালাসেমিয়ার রোগী যাদের বেচে থাকার জন্য অন্যের রক্ত গ্রহণের প্রয়োজন হয়। এতদসত্বেও এদেশে নিয়মিত রক্ত গ্রহণকারী থ্যালাসেমিয়া রোগীর সংখ্যা মাত্র ৬০ থেকে ৭০ হাজার। এরূপ তথ্যে প্রশ্ন জাগে এবং মহাপরিচালক মহোদয়ও যে প্রশ্নটি রেখেছিলেন তা হল ১৬ কোটিরও অধিক মানুষের একটি দেশে মাত্র ৭০ হাজার রোগীর চিকিৎসা নিয়ে একটি জাতীয় কর্মসূচী গ্রহণ কতটা বাস্তব সম্মত। যে দেশে এখনও বেশীর ভাগ মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে বাস করে, ডায়াবেটিস বা হার্ট ডিজিজ বা ক্যান্সারের মত রোগগুলোর প্রকোপ থ্যালাসেমিয়ার তুলনায় অনেক অনেক বেশী। এর উত্তর স্বয়ং মহাপরিচালক সহ আলোচকবৃন্দ দিয়েছেন। দেশে ডায়াবেটিস বা হার্ট ডিজিজের মত রোগের চিকিৎসায় ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে। এসমস্ত রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে দেশে ব্যাপক সুবিধা নিশ্চিত হয়েছে এবং খরচও তুলনামূলক কম। নিয়মিত চিকিৎসায় থেকে ডায়াবেটিস বা হার্ট ডিজিজ নিয়ে মানুষ দিব্যি স্বাভাবিক কর্মকান্ড করতে পারে, পরিপুর্ন বয়স পর্যন্ত বেচে থাকতে পারে। পক্ষান্তরে অন্যের শরীরের রক্ত গ্রহণই যেখানে থ্যালাসেমিয়া মেজর রোগীর বেচে থাকার উপায়, সেখানে রক্ত ও অন্যান্য ওষুধের অভাবে অধিকাংশ শিশুই ৫ বছর বয়সের মধ্যেই মারা যায়। যারা নিয়মিত রক্ত নিয়ে বেচে থাকে তারা প্রায় সকলেই রক্ত গ্রহণ জনিত নানা জটিলতায় ৩০ বছর বয়সের মধ্যে মারা যায়। ফলে থ্যালাসেমিয়া মেজর নিয়ে জন্মগ্রহণকারী রোগীর সংখ্যা শেষ পর্যন্ত দাঁড়ায় ৬০ থেকে ৭০ হাজার। এই সমস্ত রোগীর জীবন হয়ে পরে দুর্বিসহ। স্বাভাবিক কাজ করার মত শারীরিক ও মানসিক ফিটনেস তাদের থাকেনা। একটি থ্যালাসেমিয়া পরিবারের অবস্থা কি পরিমাণ দুর্বিষহ হয়ে ওঠে তা কেবলমাত্র ভুক্তভোগীই উপলব্ধি করতে পারে। সর্বক্ষন রক্ত সংগ্রহের চিন্তা, রোগীকে ব্লাড ব্যাংক বা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, তার খরচ জোগানোর চেষ্টা ইত্যাদি। চিকিৎসার খরচ জানতে চান? এই রোগের চিকিৎসার খরচ নির্ভর করে রোগীর বয়স ও শরীরের ওজন এবং রোগের মাত্রার উপর। রক্ত বেচা কেনা আইনত নিষিদ্ধ হওয়ার পরও রক্ত সংগ্রহ ও গ্রহণ এবং আনুষঙ্গিক ওষুধের খরচ মিলিয়ে একজন রোগীর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রতি বছর খরচ হয় ১,২৭,০০০ থেকে ৩,০৯,০০০ টাকা। সরকারী হাসপাতালের ফ্রি ডাক্তার আর নার্স সুবিধা না থাকলে খরচ আরও বেশী হতে পারতো। ফলে বাকি পুরোটাই বহন করতে হয় পরিবারকে। এদেশের কতটি পরিবার এরূপ ব্যয় বহন করতে পারে? যেখানে এরূপ থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত পরিবারের ৭২ শতাংশের বার্ষিক আয় মাত্র ২,৪০,০০০ থেকে ৪,৮০,০০০ টাকা। এরূপ অবস্থায় একটি থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত পরিবার দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হওয়াই স্বাভাবিক। ভয়াবহ বিষয় হল এদেশে বিভিন্ন ব্লাড ব্যাংকে ও হাসপাতালে বছরে যে পরিমাণ রক্ত সংগ্রহ করা হয় তার ৪০ শতাংশ ব্যয় হয় এই থ্যালাসেমিয়া রোগীদের চিকিৎসায়। কি পরিমাণ অপচয় হয়ে থাকে একটি রাষ্ট্র ও সমাজ অনুমান করা যায় কি? আর্থিক, মানসিক, শারীরিক, কর্মঘন্টায়? কেবলমাত্র থ্যালাসেমিয়ার কারণে সমগ্র জনগোষ্ঠীতে সুস্থ্য বছর হারানোর হার (years of healthy life lost) প্রতি হাজারে পুরুষের ক্ষেত্রে ১৪৭.২ ও মহিলাদের ক্ষেত্রে ২২৬.১ এবং বছর হিসেবে আগাম মৃত্যু জনিত আয়ুষ্কাল হারানোর হার (years of life lost to premature mortality) প্রতি হাজারে ৫১.২। সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশু ও জনসংখ্যা প্রতি বছর বেড়ে চলেছে। ক্যান্সারের চিকিৎসাও অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও হতাশাজনক। বেশ কিছু ব্লাড ক্যান্সার ও অতি অল্প সংখ্যক সলিড ক্যান্সার ছাড়া অধিকাংশ ক্যান্সার নিরাময়যোগ্য নয়। তদুপরি দেশে সরকারী পর্যায়ে ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং এসবে সরকারী ব্যবস্থাপনায় স্বল্পমূল্যে বা বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেয়া হয়ে থাকে। অথচ থ্যালাসেমিয়া একটি প্রতিরোধযোগ্য ও অনেক ক্ষেত্রে নিরাময়যোগ্য হলেও এই রোগের জন্য এখন পর্যন্ত কোন সুনির্দ্দিষ্ট সরকারী কর্মসূচী নাই। ফলে এ সংক্রান্ত একটি জাতীয় কর্মসূচী নির্ধারণ জরুরী হয়ে পড়েছে।
কিভাবে প্রতিরোধ করা যেতে পারে থ্যালাসেমিয়া?
জ্ঞাতব্য যে থ্যালাসেমিয়া জিনের বাহকদের মধ্যে এই রোগের লক্ষণ প্রায় থাকেনা বললেই চলে এবং তারা প্রায়ই স্বাভাবিক জীবন যাপন করে থাকে। যখন স্বামী ও স্ত্রী দুজনেই বাহক হয় তখন তাদের প্রতিটা সন্তানের ক্ষেত্রে থ্যালাসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ২৫ শতাংশ। আর যদি একজন রোগী ও অপরজন বাহক হয় তাহলে এ সম্ভাবনা দাঁড়ায় ৫০ শতাংশ। উভয়েই রোগী হলে তাদের প্রতিটা সন্তানই রোগী হবে। পক্ষান্তরে স্বামী ও স্ত্রীর একজন বাহক ও একজন সুস্থ্য হলে তাদের সন্তানদের কেউই এই রোগে আক্রান্ত হবেনা, যদিও তাদের সন্তানদের বাহক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ৫০ শতাংশ যা একটি রাষ্ট্রের জন্য গ্রহণযোগ্য। ফলে থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের জন্য যে কর্মসুচীই নেয়া হোক না কেন তার মুল উদ্দেশ্য থাকবে একজন বাহক বা রোগীর সাথে আরেকজন বাহক বা রোগীর বিবাহ প্রতিরোধ করা। এই উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যে সমস্ত কর্মসূচী নেয়া যায় বা নেয়া উচিৎ তা নিম্নরূপ হতে পারে।
১। ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টিঃ যেকোন জাতীয় কর্মসূচী সফল করার প্রথম পদক্ষেপ হল ব্যাপকভাবে জনগণকে সচেতন করা। জনগণকে জানাতে হবে ও বুঝাতে হবে এই রোগের লক্ষণ ও ক্ষতির দিকগুলো এবং একই সাথে তার প্রতিরোধের উপায়। এখানে প্রতিরোধের উপায় বলতে বাহক চিহ্নিত করা ও তাদের মধ্যে বিবাহ না হওয়ায় উদ্বুদ্ধ করা। জনসচেতনতা এমন পর্যায়ে হওয়া উচিৎ যেভাবে মানুষ তার ব্লাড গ্রুপ জানতে উদ্বুদ্ধ হয়। লিফলেট, বিজ্ঞাপন, বিল বোর্ড, পোস্টার, শর্ট ফিল্ম তৈরি করা যেতে পারে। খবরের কাগজ, টেলিভিশনে আলোচনা নিবন্ধ টকশো করা যেতে পারে। স্থানীয় কাউন্সিলর, মসজিদের ইমাম, স্কুল শিক্ষক, স্বাস্থ্য কর্মী এরূপ গণসচেতনতা সৃষ্টিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। অতীতে জন সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সহ বিভিন্ন জাতীয় কর্মসূচীতে এই সকল উপাদান সফল ভূমিকা রেখেছে। বর্তমানে ফেসবুক সহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম বিভিন্ন আন্দোলন ও জনসচেতনতা সৃষ্টিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশী মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। ফলে মোবাইল এসএমএসও জনসচেতনতা সৃষ্টিতে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে।
২। থ্যালাসেমিয়া নির্ণয় কেন্দ্র স্থাপনঃ ইতিমধ্যে ফেসবুক সহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়ার ভয়াবহতা নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা চলছে। এরূপ আলোচনার ফলশ্রুতিতে কোন কোন হাসপাতালে থ্যালাসেমিয়া রোগ নির্নয়ের জন্য তরুণ তরুণীরা ভিড় করছে বলে জানা গেছে। অর্থাৎ সচেতনতা সৃষ্টির সাথে সাথেই এই রোগ নির্ণয়ের সুবিধাও নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় গণসচেতনতা সৃষ্টি অর্থহীন হয়ে পড়বে বা এ থেকে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবেনা। থ্যালাসেমিয়া নির্ণয়ের জন্য যে পরীক্ষাগুলো বিশেষভাবে প্রয়োজন তা হল রক্তের রেড সেল ইনডেক্স দেখা, মাইক্রোস্কোপে রক্তের ফিল্ম (পিবিএফ) দেখা এবং সবশেষে হিমোগ্লোবিন ইলেট্রোফোরেসিস পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া। কিন্তু হিমোগ্লোবিন ইলেট্রোফোরেসিসের স্থাপনা ও মেইন্টেনেন্স খরচ বেশী বলে দেশের মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি সরকারী ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এই সার্ভিস রয়েছে। ফলে এই সুবিধা দেশের জনগণের দোরগোড়ায় হয়ত দেয়া সম্ভব নয় এবং স্ক্রিনিং বা রোগ নির্ণয়ের জন্য সবাইকে এই পরীক্ষা করাটা আমাদের বর্তমান স্বাস্থ্য কাঠামোতে এই মুহুর্তে বাস্তব সম্মত নয়। যেটি করা যায় তা হলে প্রথমে একটি সহজ ও সাশ্রয়ী পরীক্ষার মাধ্যমে সন্দেহজনক বাহক নির্ণয় করতে হবে। তারপর তাদেরকে হিমোগ্লবিন ইলেট্রোফোরেসিসের আওতায় এনে বাহক নিশ্চিত করা যেতে পারে। এ কাজে যে পরীক্ষাটি সহজলভ্য ও সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তা হল রেড সেল ইনডেক্স দেখা। রেড সেল ইনডেক্স পরীক্ষা করা হলে স্ক্রিনিংএর জন্য হিমোগ্লবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিসের প্রয়োজনীয়তা প্রায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব। আর এ জন্য দরকার হেমাটোলজি অটোএনালাইজার বা সিবিসি এনালাইজার। এই সিবিসি এনালাইসিসের সুবিধাটি শুধু থ্যালাসেমিয়া নির্ণয়ের জন্য নয়, যেকোন রোগের পরীক্ষার ক্ষেত্রে একটি প্রাথমিক ও সাধারণ কিন্তু অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পরীক্ষা। কিন্তু এই সাধারণ মেশিনটিই আমাদের দেশের সকল থানা পর্যায়ে নাই। কাজেই আমাদের জনবান্ধব সরকারের পক্ষে দেশের প্রতিটি উপজেলা হাসপাতালে সিবিসি এনালাইজার সুবিধা নিশ্চিত করা উচিৎ। শুধু থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের জন্যই নয়, আমাদের ক্রমাগত উন্নতিশীল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্যই সিবিসি অটোএনালাইজার সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এই পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাপ্ত সন্দেহযুক্ত কেসগুলো নিশ্চিত হওয়ার জন্য উচ্চতর হাসপাতাল বা সেন্টারে বা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে রেফার করা হলে থ্যালাসেমিয়া নির্ণয় প্রক্রিয়া বাস্তব সম্মত হতে পারে। থ্যালাসেমিয়া নির্ণয়ের জন্য পরবর্তি পর্যায় হতে পারে প্রতিটি সরকারী মেডিকেল কলেজে ক্যাপিলারি হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিস নামক পরীক্ষার সুবিধা নিশ্চিত করা। ক্যাপিলারি হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিস পরীক্ষার মাধ্যমে অধিকাংশ ক্ষেত্রে থ্যালাসেমিয়া নির্ণয় ও তার প্রকার নিশ্চিত করা সম্ভব। অনেক ক্ষেত্রে শরীরে আয়রনের ঘাটতি থাকলে বাহক নির্ণয় কঠিন হয়ে পরে। এজন্য উপজেলা হাসপাতালে সিবিসি এনালাইজার সুবিধা নিশ্চিত করার পাশাপাশি আয়রন পরীক্ষার সুবিধাও নিশ্চিত করা জরুরী। বিশেষ ক্ষেত্রে এবং গবেষণার প্রয়োজনে থ্যালাসেমিয়ার জেনেটিক পরীক্ষার জন্য একটি কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগার স্থাপন করাও জরুরী। অবশ্য সরকারী পর্যায়ে না হলেও মহাখালীস্থ আইসিডিডিআরবিতে সীমিত আকারে থ্যালাসেমিয়ার জেনেটিক পরীক্ষা করা হচ্ছে।
৩। আইন প্রণয়নঃ বিয়ের আগে বা বিয়ের সময় পাত্র-পাত্রীর উভয়ের বাধ্যতামূলক থ্যালাসেমিয়ার পরীক্ষা করা ও তা প্রকাশ করার জন্য আইন প্রণয়ন করতে হবে। প্রয়োজনে থ্যালাসেমিয়া বা এই জাতীয় জরুরী অন্য কোন জেনেটিক রোগ আছে কি নাই তা লিপিবদ্ধ করার জন্য কাবিন নামায় অতিরিক্ত একটি অনুচ্ছেদ সংযোজন করা ও তাতে একজন রেজিষ্টার্ড ডাক্তারের স্বাক্ষর থাকার ব্যবস্থা করা উচিৎ। তবে বাহক বা রোগীদের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধের আইন সঙ্গত নয়, আইন হতে হবে পাত্র বা পাত্রীর থ্যালাসেমিয়া বা এই জাতীয় গুরুতর কোন জেনেটিক রোগ আছে কিনা তা প্রকাশ করতে বাধ্য করার আইন। কেবলমাত্র পাত্র-পাত্রী পরস্পরকে জানার পরই তারা বিয়ে করতে পারবে বলে আইন থাকা দরকার। আইন প্রণয়নের বিকল্প নাই। কারণ বিবাহপুর্ব সংশ্লিষ্ট পাত্র-পাত্রীর থ্যালাসেমিয়ার পরীক্ষা করা এবং তা পরস্পরের কাছে প্রকাশ করা আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে একটি অত্যন্ত সেনসিটিভ ও কঠিন বা জটিল একটি বিষয়। অথচ আলোচ্য কর্মসূচীর সকল কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে থ্যালাসেমিয়ার বাহক বা রোগীদের মধ্যে বিবাহে বাধা দান বা নিরুৎসাহিত করা। সামাজিক কারণেই পাত্র-পাত্রীর যেকোন দুর্বলতা প্রকাশ করা হয়না। বরং ব্যতিক্রম ছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুর্বলতা গোপন করা হয়। থ্যালাসেমিয়া বিষয়ক দুর্বলতাও এর ব্যতক্রম হবেনা। কিন্তু আইন প্রণয়ন করে বিবাহের পূর্বে পাত্র-পাত্রীর উভয়ের থ্যালাসেমিয়ার অবস্থা প্রকাশ করতে বাধ্য করা হলে সামাজিক জটিলতাগুলো অনেকাংশেই উত্তরণ করা সম্ভব। বিশ্বের যেসব দেশে সফল ভাবে থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে সেসব প্রতিটা দেশেই বাধ্যতামূলক বিবাহপূর্ব থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা করা ও তা প্রকাশ করার আইন রয়েছে। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে আইন আছে, এমনকি উপমহাদেশের পাকিস্তানেও এইরূপ আইন সম্প্রতি প্রণয়ন করা হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন আমাদের দেশে অনেক বিষয়েই আইন আছে কিন্তু তার প্রয়োগ নাই, ফলে এধরণের আইন প্রণয়ন আরেকটি কেতাবি আইনের জন্ম দিবে। তাদের উদ্দেশ্যে এতটুকু বলাই শ্রেয় যে আইন থাকলেই তার অনুশীলনের প্রশ্ন আসে, না থাকলে নয়। এধরণের একটি আইন যদি ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রেও অনুশীলন হয় তাহলেও আমাদের উদ্দেশ্য কমপক্ষে ৫০ শতাংশ সাধিত হবে।
প্রতিরোধ কর্মসূচী তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম বছরে ডায়াগনস্টিক সুবিধা নিশ্চিত করা ও সংশ্লিষ্ট জনবলের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়া। দ্বিতীয় বছর থেকে গণসচেতনতা মূলক কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা। শেষ পর্যায়ে বিবাহের শর্ত হিসেবে থ্যালাসেমিয়ার পরীক্ষার ফলাফল বাধ্যতামূলক প্রকাশ করার আইন প্রণয়ন করা। এই শেষ পর্যায়ে প্রতিটি পাত্র পাত্রীর জন্য হিমোগ্লবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিস পরীক্ষার সুবিধা ব্যাপক ভাবে নিশ্চিত করতে হবে।
থ্যালাসেমিয়া রোগীদের ক্ষেত্রে করনীয়ঃ
আগেই বলা হয়েছে থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল, সামাজিক কারণে বিব্রতকর এবং হতাশাজনক। অন্যের রক্ত গ্রহণ করে তাদের বেচে থাকতে হয়। ইতিমধ্যে স্বেচ্ছায় রক্ত দানের জন্য গণসচেতনতা মূলক কার্যক্রম চালু আছে। এই কার্যক্রম আরও জোরদার করা উচিৎ যাতে থ্যালাসেমিয়ার রোগীদের রক্ত গ্রহণ সহজলভ্য হয়। সারা দেশে অনেক ব্লাড ব্যাংক রয়েছে। প্রতিটা ব্লাড ব্যাংকে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের রক্ত পরিসঞ্চালনের জন্য আলাদা বেড নিশ্চিত করা জরুরী। একইসাথে রক্ত পরিসঞ্চালন জনিত রোগ প্রতিরোধকল্পে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন নিশ্চিত করতে হবে। এ বিষয়ে বিধিমালা প্রণয়ন ও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের নজরদারি জোরদার করা প্রয়োজন। পুনঃপুনঃ রক্ত গ্রহণের কারণে শরীরে যে ক্ষতিকর অতিরিক্ত আয়রন জমা হয় তার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধের স্বল্পতা রয়েছে দেশে এবং প্রাপ্ত ওষুধের দামও অধিকাংশ রোগীর নাগালের বাইরে। দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো যাতে এই সমস্ত ওষুধ তৈরি করে ও তার দাম নাগালের মধ্যে থাকে তার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে। কিংবা সরকারী মালিকানাধীন ইডিসিএল প্রয়োজনীয় ওষুধ তৈরি ও স্বল্পমূল্যে বিপণন করতে পারে অথবা সরকারী হাসপাতালে এসব ওষুধ বিনামূল্যে বিতরণ করার ব্যবস্থা করা উচিৎ। এ জন্য থ্যালাসেমিয়া রোগীদের একটি সরকারী রেজিস্ট্রি থাকা প্রয়োজন। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের পরিপূর্ণ নিরাময়ের জন্য একমাত্র চিকিৎসা হল বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট। এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল, ঝুকিপূর্ণ এবং তা ডোনার থাকা সাপেক্ষে সম্ভব। এর মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়ার পরিপুর্ণ নিরাময়ের হার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ। যদিও এই চিকিৎসায় রোগীর বংশগতি পরিবর্তন হয়না, কিন্তু রোগী পরিপূর্ণ সুস্থ্য জীবন যাপন করতে পারে। দেশের সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ইতিমধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও সিএমএইচে বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু সেগুলোতে সীমিত আকারে কেবলমাত্র কয়েকটি রোগের জন্য অটোলোগাস ট্রান্সপ্লান্ট করা হচ্ছে। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয় এলোজেনিক ট্রান্সপ্লান্ট এখনও শুরু করা সম্ভব হয়নি। এসব সেন্টারে থ্যালাসেমিয়ার রোগীদের প্রয়োজনীয় ট্রান্সপ্লান্ট শুরু করা উচিৎ।
তথ্য সুত্রঃ আলোচনা সভায় পরিবেশিত ডঃ সরোয়ার ও তার দলের গবেষণা পত্র, আইসিডিডিআরবির গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য, বিভিন্ন ওয়েবসাইটে প্রাপ্ত তথ্য, সভায় অংশ গ্রহণকারীদের আলোচনা থেকে প্রাপ্ত তথ্য।
ডাঃ মোঃ কামরুল হাসান
রক্তরোগ ও ব্লাডক্যান্সার বিশেষজ্ঞ
Last Updated on 21/06/2020 by Editorial Staff
Comments
বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ কর্মসূচীর বিষয়ে প্রস্তাবনা — No Comments
HTML tags allowed in your comment: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>