প্রশ্নোত্তরে ব্লাড ক্যান্সার
রক্তক্যান্সার!!! একটি ভয় ও কষ্টের নাম। পরিবারের কেও রক্তক্যান্সারে আক্রান্ত হলেই পরিবারের উপর একটা বিশাল আতংক, অবিশ্বাস আর কিংকর্তব্যবিমুঢ়তা নেমে আসে। বিশেষ করে রক্তক্যান্সার রোগ ও এর চিকিৎসা সম্পর্কে অজ্ঞতা ও ভুল ব্যক্তির ভুল পরামর্শ সম্মানিত রোগী ও রোগীর পরিবারের অনেক ক্ষতি করে। অথচ বিজ্ঞ তুখোড় চিকিৎসা বিজ্ঞানী তথা সম্মানিত মেধাবী চিকিৎসকগণের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সর্বোপরি মহান আল্লহর অশেষ রহমতে অনেক রক্তক্যান্সারও আজ পরাজিত এবং আমাদের দেশেও হচ্ছে রক্তক্যান্সারের চিকিৎসা। আন্তর্জাতিক মানদন্ডে পিছিয়ে নেই আমাদের চট্টগ্রামও।
এমন কিছু আশার কথা নিয়ে এবং এই রোগ আক্রান্ত রোগী ও তাঁদের পরিবারের কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আজকের এই প্রশ্ন।
রক্তক্যান্সার কি?
উঃ রক্তের যে কোন কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি থেকেই রক্তের ক্যান্সার জন্ম নেয়। একটি অস্বাভাবিক কোষ থেকে দশটি, সেই দশটির প্রতিটি থেকে আরও দশটি করে পরবর্তীতে আরও শত-সহস্র-লক্ষ, এভাবেই এরা বাড়তে থাকে। অস্বাভাবিক কোষগুলো নিজের কাজ ঠিক মত করে না, অন্য স্বাভাবিক কোষকে জন্ম নিয়ে ঠিক মত বাড়তে দেয়না, বিভিন্ন অঙ্গে জমে গিয়ে সেইসব অঙ্গের কাজে নানা বাঁধা দেয়। ফলে কঠিন হয়ে পরে স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকা।
কোন ধরণের রক্তকোষে ক্যান্সার বেশি হয়?
উঃ শ্বেতকণিকা বা WBC -ই প্রধানত রক্ত ক্যান্সারে বেশি আক্রান্ত হয়।
সবারই কি রক্তক্যান্সার হতে পারে?
উঃ রক্তের ক্যান্সার সব বয়সের, পেশার, জাত, ধর্মের নারী পুরুষের হতে পারে। কোন কোন নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে একটু কম বেশি হলেও মোটামুটি সমাজের সব অংশ থেকেই এসব রোগের রোগীগণ আসেন। নির্দিষ্ট কিছু ক্যান্সার নির্দিষ্ট বয়সে বেশি হয়।
রক্তক্যান্সার কি কি প্রকারের হয়?
উঃ সহজভাবে বললে রক্তের ক্যান্সার দুই রকম।
একিউট বা স্বল্প সময়ে খুব দ্রুত জন্ম নেয়া ক্যান্সার। এর মধ্যে পরে এ. এল. এল. /ALL (একিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া), এ. এম. এল. /AML(একিউট মায়েলোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া), মাল্টিপল মায়েলোমা/MM (অনেক সময় আস্তে আস্তেও হয়) আর কিছু লিম্ফোমা/Lymphoma (হজকিনস লিম্ফোমা/Hodgkin’s lymphoma/ Hodgkin’s Disease/ HLও নন হজকিনস লিম্ফোমা / Non Hodgkin’s Lymphoma/ NHL)।
আরেক ধরনের রক্তের ক্যান্সার হল ক্রনিক বা লম্বা সময় ধরে ধীরে ধীরে বাড়া ক্যান্সার। এর মধ্যে পরে সি. এল. এল. /CLL (ক্রনিক লিম্ফোসাইটিক লিউকেমিয়া), সি. এম. এল. /CML (ক্রনিক মায়েলয়েড লিউকেমিয়া) ও কিছু লিম্ফোমা।
এর বাইরে এম. ডি. এস. /MDS (মায়েলো ডিসপ্লাসিয়া বা মায়েলো ডিসপ্লাস্টিক সিন্ড্রোম), পলিসাইথেমিয়া/PRV, মায়েলোফাইব্রোসিস/myelofibrosis , এসেনশিয়াল থ্রম্বোসাইথেমিয়া/ET ইত্যাদি কিছু রক্তের রোগকে সরাসরি রক্তক্যান্সার বলবেন না প্রিক্যান্সারাস বা পরবর্তীতে রক্তক্যানসার হতে পারে এমন অবস্থা বলবেন এ নিয়ে দেশ বিদেশের সম্মানিত বিজ্ঞ চিকিৎসকগণ নানা মতে বিভক্ত।
রক্তক্যান্সারের লক্ষণ কি?
উঃ রক্ত ক্যন্সারের লক্ষণ হল জ্বর, অধিক দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট, একাধিকবার শরীরে রক্ত দিতে হওয়া, চামড়ায় বিভিন্ন আকারের ছোট বড় লাল কাল নীল রক্তের দাগ আসা, মাড়িতে রক্ত পড়া, গলায়, বগলে, কোমরের কুঁচকিতে গোল হয়ে ফুলে যাওয়া (টিউমার বা ছোট বলের মত), পেট ফোলা, লিভার ও স্পলিন (spleen) বা প্লিহা বড় হয়ে যাওয়া, জন্ডিস, জয়েন্ট ফোলা আর ব্যথা (বিশেষ করে বাচ্চাদের), শরীর ব্যথা, হাড় কোমড়ে ব্যথা ( বিশেষ করে বয়স্কদের)। মাড়ি ফুলে যাওয়া একটি বিশেষ ধরনের রক্ত ক্যান্সারের লক্ষণ।
এই লক্ষণগুলো কি অন্য রোগেও হতে পারে?
উঃ এই সব কিছুই অন্য অনেক রোগেও হতে পারে। তাই খুব বেশি হেলাফেলা না করে সংশ্লিষ্ট সম্মানিত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণের সাথে দ্রুত যোগাযোগ করা উচিৎ।
রক্তের সিবিসি/cbc/complete blood count পরীক্ষায় কি রক্তক্যান্সারের আলামত বোঝা যায়?
উঃ সিবিসি পরীক্ষায় অনেক সময় রক্তের WBC বা শ্বেত কণিকা বেড়ে যায়। সাথে লিম্ফোসাইট/ Lymphocyte বা মনোসাইট/Monocyte বেড়ে যেতে পারে। এই বেড়ে যাওয়া কোষগুলোর মধ্যে রক্তক্যান্সার কোষ থাকতে পারে।
রক্তের হিমোগ্লোবিন/Hb কমে যাওয়া, ESR (ইএসআর) বেড়ে যাওয়া হতে পারে রক্তক্যান্সারের লক্ষণ। অনেক সময় রক্তক্যান্সারের লক্ষণ হিসেবে সিবিসি পরীক্ষায় প্লেটলেট/Platelet অথবা শ্বেতকণিকা/ WBC অথবা হিমোগ্লোবিন /Hb আলাদা আলাদা ভাবে অথবা একসাথে কমে যেতে পারে।
কিছু মায়েলোপ্রোলিফারেটিভ নিওপ্লাসম/ MPD বা এক ধরণের রক্তক্যান্সারে হিমোগ্লোবিন বা প্লেটলেট বেড়ে যেতে পারে যা সিবিসি পরীক্ষাতে ধারণা করা যায়।
রক্তক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য কি কি পরীক্ষা করা হয়?
উঃ রোগ নির্ণয় এর জন্য রক্তের cbc with peripheral blood film/PBF সহ বেশ কিছু পরীক্ষা, বোন ম্যারো পরীক্ষা( Bone marrow study) , ট্রিফাইন বায়োপ্সি, লিম্ফনোড বায়োপ্সি, কিছু সূক্ষ পরীক্ষা যেমন ফ্লো সাইটোমেট্রি, ইমিউন হিস্টোকেমিস্ট্রি, ডিএনএ এনালাইসিস বা সাইটোজেনেটিক্স এসব পরীক্ষা করতে হয়। বিশেষ ধরণের রক্ত ক্যান্সারে শরীরের বিভিন্ন প্রোটিনের পরীক্ষাও বিশেষ পদ্ধতিতে করতে হয়।
বোনম্যারো পরীক্ষা কি ও কিভাবে করা হয়?
উঃ বোনম্যারো বা অস্থি মজ্জা হল রক্ত তৈরির কারখানা। এটি থাকে হাড়ের মধ্যে। ইনজেকশন দিয়ে অবশ করার পর একটি ছোট সুঁই দিয়ে হাড়ের ভিতর থেকে অস্থি মজ্জা নিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে বোন ম্যারোর অবস্থা দেখাকে বোন ম্যারো পরীক্ষা বা বোন ম্যারো স্টাডি বলে। উন্নত বিশ্বে এই পরীক্ষার সাথেই রুটিন হিসেবেই আরেকটি সুঁই দিয়ে পেন্সিলের শীষের মত ছোট আধা ইঞ্চির কম হাড় নেওয়া হয় এবং বিশেষ পদ্ধতিতে মাইক্রোস্কোপে দেখা হয়। একে ট্রেফাইন বায়োপ্সি বলে। বিশেষ করে রক্ত ক্যান্সার নির্ণয় ও স্টেজ নির্ণয়ের জন্য বোন ম্যারো আর ট্রেফাইন বায়োপ্সি স্যাম্পল থেকে ফ্লো সাইটোমেট্রি, ইমিউন হিস্টো কেমিস্ট্রি, সাইটোজেনেটিক্স সহ বিভিন্ন মলিকিউলার পরীক্ষা করতে হয়।
এই পরীক্ষাগুলো কি আমাদের দেশে / চট্টগ্রামে হয়?
উঃ এখন আমাদের দেশেই নিয়মিত এই সব পরীক্ষা হচ্ছে। বেশি প্রয়োজন হলে স্যাম্পল বিদেশে পাঠানো যায়। বর্তমানে চট্টগ্রামেই উন্নত বিশ্বের মত সম্পূর্ণ ব্যথামুক্তভাবে এসব পরীক্ষা করা হচ্ছে। চটগ্রামে মহান আল্লহর দয়ায় আমি প্রথম ব্যথামুক্ত বোনম্যারো ও ট্রেফাইন বায়োপসি পরীক্ষা শুরু করেছি।
ক্রনিক ক্যান্সার কি ভাল হয়?
উঃ অনেক ক্রনিক ক্যান্সার নিরাময়যোগ্য। রোগীর বয়স, শারীরিক অবস্থা ইত্যাদির উপর নির্ভর করে মুখে খাওয়ার ঔষধ বা ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে নিয়মিত বিরতিতে সঠিক নিয়ম মেনে সম্মানিত রক্ত রোগ বিশেষজ্ঞগণের তত্ত্বাবধানে থাকলে ইনশা আল্লাহ অনেক ক্রনিক লিউকেমিয়ার বা রক্তক্যান্সারের রোগীগণ সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যান। যারা সম্পূর্ণ সুস্থ হন না, তারাও ইনশা আল্লাহ চিকিৎসার মাধ্যমে রোগকে দমিয়ে রাখতে পারেন।
একিউট ক্যান্সার কি নিরাময়যোগ্য?
উঃ হ্যা। ক্রনিক ক্যান্সারের মতই একইভাবে বিভিন্ন ফ্যাক্টর, স্টেজ ইত্যাদির উপর নির্ভর করে অনেক একিউট ক্যান্সার নিরাময় যোগ্য।
রক্তক্যান্সারের চিকিৎসা কি?
উঃ প্রধানত রক্তক্যান্সারের চিকিৎসা করা হয় কেমোথেরাপী, ইমিউন থেরাপি বা ঔষধ এর মাধ্যমে। কিছু সংখ্যক রক্তক্যান্সারকে ঔষধ এর মাধ্যমে দমিয়ে রাখা হয়। আবার যদি রোগ ফিরে আসে অথবা প্রাথমিকভাবে যদি মনে হয় রোগ বেড়ে যাবে ঔষধ এর পরও; তাহলে পুনরায় ঔষধ নিতে হয় বা বোন ম্যারো স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্ট করতে হয়। আর অল্প কিছু রক্তের একিউট ক্যান্সার শুরুতেই সরাসরি ট্রান্সপ্লান্ট করতে হয়।
রক্তক্যান্সার চিকিৎসায় অপারেশন বা সার্জারীর ভূমিকা কি?
উঃ অন্য অনেক ক্যান্সারের মত রক্ত ক্যান্সারে দ্রুত অপারেশন করে সুস্থ হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ রক্ত কেটে ফেলে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই ওষুধ দিয়েই চিকিৎসা করতে হয়। মাঝে মাঝে রেডিও থেরাপী, বোন ম্যারো স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্ট প্রয়োজন হয়।
কেমোথেরাপি কেমন শক্তিশালী?
উঃ যেসব ওষুধ রক্ত ক্যান্সারের রোগীগণকে দেওয়া হয় সেগুলো বিভিন্ন মাত্রার শক্তিশালী হয়। অধিক শক্তিশালী ওষুধ অনেক সময় ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করার সাথে সাথে শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটায়। রক্ত কমে যাওয়া, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, রক্তপাত হওয়া, চুল পড়ে যাওয়া, জ্বর আসা ইত্যাদি নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে। স্বল্প মাত্রার কেমোথেরাপি সাধারণত খুব বেশি সমস্যা করে না তবে সাবধান থাকা খুব জরুরি।
কেমোথেরাপির এসব প্বার্শ প্রতিকৃয়া কিভাবে রোধ করা যায়?
উঃ অনেক রোগীর তেমন কোন প্বার্শপ্রতিকৃয়া হয়না বললেই চলে। তবে সব সময় এসব প্বার্শপ্রতিকৃয়া রোধ করা সম্ভব হয় না।কিন্তু এসব সমস্যা দূর করার বা ঠেকিয়ে রাখার জন্যও নানা চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। যেমন রক্ত কমে গেলে লাল বা সাদা রক্ত দিতে হয়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে, জ্বর আসলে চামড়ার নিচে কিছু ইঞ্জেকশন দিতে হয়। জ্বরের জন্য এন্টিবায়োটিক ইত্যাদি দিতে হয়। কিডনি হৃদযন্ত্র লিভারের সমস্যাসহ শরীরের পুষ্টি ও লবনের ঘাটতি মেটাতেও আগে থেকেই নানা ব্যবস্থা নিতে হয়। প্রয়োজনে সাময়িকভাবে আইসিইউতে বিশেষ চিকিৎসা করতে হয়।
কেমোথেরাপি শেষ হতে কত সময় লাগে?
উঃ এটা বিভিন্ন রোগে বিভিন্ন রকম। লিম্ফোমা বা মাল্টিপল মায়েলোমা জাতীয় রোগে ২১ বা ২৮ দিনের সাইকেলে প্রথমে চার সাইকেল কেমো দিতে হয়। এএমএল/AML এ সাধারণত ২৮ দিনের সাইকেলে চার মাস কেমো দিতে হয়। এএলএল/ALL এ সাধারণত নির্দিষ্ট সাইকেল পর পর হিসেব করে ছেলেদের ক্ষেত্রে তিন বছর আর মেয়েদের ক্ষেত্রে দুই বছর কেমো নিতে হয়। সিএমএল/CML এর কেমো সারাজীবন লাগতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কেমোথেরাপি একটি দীর্ঘ মেয়াদি প্রকৃয়া।
কিউরেটিভ কেমোথেরাপি কি?
উঃ রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করার জন্য আল্লহর উপর ভরসা করে যেসব কেমো প্রটোকল দেওয়া হয় সেটি হল কিউরেটিভ কেমোথেরাপি। এক্ষেত্রে সাধারণত শক্তিশালী ওষুধ দেওয়া হয়।
প্যালিয়েটিভ কেমোথেরাপি কি?
উঃ রোগ সারার সম্ভাবনা কম থাকলে, উচ্চমাত্রার কেমোথেরাপির জন্য রোগীর শারীরিক আর্থিক সামর্থ কম থাকলে যে স্বল্প মাত্রার ও কম প্বার্শপ্রতিকৃয়াযুক্ত কেমোথেরাপি দেওয়া হয় তাকে প্যালিয়েটিভ কেমোথেরাপি বলে।
ডে কেয়ার কেমোথেরাপি কি?
উঃ রোগী ভর্তি না হয়েই নির্দিষ্ট সময় পরপর চেম্বারে বা বহির্বিভাগে এসে কেমো থেরাপি নিয়েই বাসায় চলে যাওয়াকে ডে কেয়ার কেমোথেরাপি বলে।
ইনডোর কেমোথেরাপি কি?
উঃ যেসব কেমোথেরাপি একটু শক্তিশালী তাই রোগী ভর্তি রেখে দিতে হয় সেগুলো হল ইনডোর বা ইন প্যাশেন্ট কেমোথেরাপি।
বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট কি?
উঃ রোগীর অসুস্থ অস্থিমজ্জ্বাকে উচ্চ মাত্রার কেমোথেরাপি বা রেডিও থেরাপি দিয়ে নষ্ট বা অকার্যকর করে দিয়ে পরবর্তীতে সুস্থ অস্থিমজ্জ্বা রোগীর শরীরে স্থাপন করার নাম হল বোন ম্যারো স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টেশন।
বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট কয় প্রকার?
উঃ সাধারণভাবে বললে বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট দুই প্রকার। এলোজেনিক ট্রান্সপ্লান্টেশন যেখানে অন্য একজন ডোনারের বোন ম্যারো রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। আর অটোলোগাস ট্রান্সপ্লান্টেশন যেখানে রোগীর নিজের সুস্থ স্টেম সেল দিয়েই রোগীকে ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়।
এর ব্যয় কেমন? আমাদের দেশে হয়?
উঃ বোন ম্যারো স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্ট একটি জটিল ও অত্যন্ত ব্যয়বহুল চিকিৎসা। আমাদের দেশেই বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট করছেন সম্মানিত রক্তরোগ বিশেষজ্ঞগণ। সব রক্ত ক্যান্সারে ট্রান্সপ্লান্ট দরকার হয় না। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে ট্রান্সপ্লান্টই একমাত্র চিকিৎসা। রোগের প্রকৃতি, রোগীর শারীরিক অবস্থা, অর্থনৈতিক অবস্থা সব কিছু মাথায় রেখেই এই চিকিৎসা ব্যবস্থা নিতে হয়। বাইরের দেশের চেয়ে আমাদের দেশের বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট সহ সকল ক্যান্সারের চিকিৎসার খরচ কম।
প্বার্শপ্রতিকৃয়াবিহীন কেমোথেরাপি বা ট্রান্সপ্লান্ট আছে?
উঃ এটা বলা খুব কঠিন। মনে রাখতে হবে ট্রান্সপ্লান্ট বা কেমোথেরাপী কোনটাতেই শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলা সম্ভব নয় যে রোগীর কোন প্বার্শপ্রতিক্রিয়া হবে না। এসব পার্শ্বপ্রতিকৃয়ার যথাযথ চিকিৎসাও আন্তর্জাতিক নিয়ম ও মান মেনে করা হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রেই অনেক রোগীর তেমন কোন প্বার্শপ্রতিকৃয়া হয়না।
কেমোথেরাপি বা ট্রান্সপ্লান্টের সময় কি রক্ত লাগে?
উঃ হ্যা। কেমোর শক্তি ও রোগীর শরীরের রেস্পন্সের উপর ভিত্তি করে সাদা রক্ত বা প্লেটলেট, লাল রক্ত বা পেকড সেল/PCV/RCC আর প্লাসমা /FFP ও CRYOPRECIPITATE লাগতে পারে। খুব অল্প সংখ্যক রোগীর রক্তই লাগেনা। অনেকের অনেক ব্যাগ রক্ত লাগতে পারে।
এসব রক্তের উপাদানগুলো কি চট্টগ্রামে / বাংলাদেশে পাওয়া যায়?
উঃ হ্যা সব গুলোই পাওয়া যায়।
কেমোথেরাপি না নিলে কি হয়?
উঃ ক্যান্সার কোষ শরীরকে খুব দ্রুত গ্রাস করে ফেলবে যদি ভয় পেয়ে চিকিৎসা না করা হয়। সব ঠিক থাকলে কেমোথেরাপী বা ট্রান্সপ্লান্টই হল সুস্থ হওয়ার পথ। তাই এর কোন বিকল্প এখন পর্যন্ত নেই।
কেমোথেরাপি নিতে দেরি করলে কি হয়?
উঃ রোগীর রোগ সারতে খুব অসুবিধা হয় যখন অনেকেই চিকিৎসার সীদ্ধান্ত দিতে অনেক দেরি করেন। এর ফলে রোগীর অনেক ক্ষতি হয়। ক্যান্সার হল দেহের ভিতর একটি অস্বাভাবিক কোষ যা খুব দ্রুত তার মতই আরও অনেক অস্বাভাবিক কোষ জন্ম দিচ্ছে। সেই নতুন কোষগুলোও আরও লাখ লাখ অস্বাভাবিক কোষ জন্ম দিচ্ছে। এই কোষগুলো বিভিন্ন অংগে ছড়িয়ে পড়ে জীবনের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এর মধ্যেই হঠাৎ কিছু ক্যান্সার কোষ হয়ে যায় কেমো বা ঔষধ প্রতিরোধি। তারা জন্ম দেয় আরও ঔষধ প্রতিরোধি কোষ। তখন শরীরে আর ঔষধ কাজ করতে চায় না। রোগ ছড়িয়ে গিয়ে চিকিৎসা আরও কঠিন হয়ে যায়। আরো বেশি কেমোথেরাপি লাগে। কমপ্লিকেশন এর রিস্ক বাড়ে। খরচ বাড়ে। সুস্থতার আশা কমে যায়। এ কারণেই রোগ বেশি ছড়িয়ে পড়া বা সেই ঔষধ প্রতিরোধি রক্ত ক্যান্সার কোষ জন্ম নিয়ে বংশবৃদ্ধির আগেই দ্রুত চিকিৎসা নিয়ে ক্যান্সার কোষকে ধ্বংস করে ফেলতে পারলে রোগ ভাল হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। এই জন্যই রক্ত ক্যান্সার বা যে কোন ক্যান্সারেই দ্রুত চিকিৎসা শুরু করাটা খুব জরুরি। প্রতিটি দিন নয়, প্রতিটি ঘন্টা নয় বরং প্রতিটি মিনিটই খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
রক্তক্যান্সার চিকিৎসার প্রধান বাঁধাগুলো কি কি?
উঃ রক্তক্যান্সার চিকিৎসায় প্রধান বাঁধা হল অর্থনৈতিক। রোগ নির্ণয়ের টেস্ট আর কেমোথেরাপির ঔষধ খুব দামী। রোগীর জ্বর আসলে দামী এন্টিবায়োটিক, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে দামী ইঞ্জেকশন, রক্তের খরচ, হাসপাতালে থাকা খাওয়া এসবের পিছনে অনেক টাকা খরচ হয়। অনেক সময় সাময়িকভাবে আইসিইউ যেতে হতে পারে (সবার নয়)।
আরেকটি সমস্যা হল চিকিৎসা শুরু করতে দেরি। দরিদ্র মানুষের দেরির কারণ প্রধানত আর্থিক সমস্যা। কিন্তু যারা সামর্থ্যবান এমনকি দরিদ্রদের মধ্যেও অনেকেই বিভিন্ন মানুষ; যারা সম্মানিত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নন তাদের সাথে পরামর্শ করেন। মজার ব্যাপার হল একজন সম্মানিত চিকিৎসক যাঁরা সমাজের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত তাঁরা ছয় বছর পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন পড়াশোনা করে এমবিবিএস পাস ডাক্তার হন। এরপর আরো পাঁচ বছর পড়াশোনা করে রক্তরোগ ব্যতীত অন্য বিষয়ে তাঁরা সম্মানিত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হন। কিন্তু রক্ত ক্যান্সারের বিশাল জ্ঞ্যানের জগৎ নিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হয়েও তাঁরা কোন মন্তব্য করেন না। কারণ এটা সম্মানিত রক্তরোগ ও রক্তক্যান্সার বিশেষজ্ঞগণের কাজ।
কিন্তু আমাদের রক্তক্যান্সার রোগীদের ও তাদের পরিবারের সদস্যদের বিশাল একটা অংশই পাত্র পাত্রী দেখার মত করে রোগ- চিকিৎসা- কোন হাসপাতাল -কোন ওষুধ বেশি ভাল ইত্যাদি বিষয় নিয়ে নানা মুনির নানা মত নিতে থাকেন। ওনারা নানান বিষয়ে বিজ্ঞ হলেও বোধগম্য কারণেই ক্যান্সার চিকিৎসার ব্যাপারে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। দু’একবার নিজের কোন রোগীর চিকিৎসা করানো কারও মতামত আর শত হাজার রোগীর চিকিৎসা করা সম্মানিত রক্তরোগ ও রক্তক্যান্সার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণের মতামতের মধ্যে কোনটির গুরুত্ব বেশি তা অনেক শিক্ষিত মানুষও বুঝতে পারেন না।
অনেকেই বিভিন্ন বিদেশী হাসপাতালের এজেন্ট এর খপ্পরে পড়ে দেশে চিকিৎসা শুরু করেন না। আর এদিকে দেরি করতে করতে রোগ বেড়ে আয়ত্বের বাইরে চলে যায়। অনেকেরই ভিসা প্রসেসিং করতে করতে আর চিকিৎসাই নেওয়া হয়না। এটা আমাদের দেশে রক্তক্যান্সার চিকিৎসার পথে বড় একটি বাঁধা।
আরেকটি সমস্যা হল দীর্ঘ সময় ধরে চিকিৎসা। রোগের প্রকৃতি ভেদে বিভিন্ন সাইকেলে বিভিন্ন ওষুধ মাস পেরিয়ে বছর বছর নিতে হয়। যেমন একিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়ার চিকিৎসা দুই থেকে তিন বছর নিতে হতে পারে। লম্বা সময় ধরে দামি ওষুধ, সংশ্লিষ্ট ল্যাব টেস্ট বারবার করা, সম্মানিত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণের সাথে সিরিয়াল নিয়ে যোগাযোগ করা ধৈর্যের এক কঠিন পরীক্ষা।
প্রধানত এই কারণগুলোর জন্য রক্তক্যান্সার চিকিৎসায় সম্মানিত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ বাঁধা অনুভব করেন।
বাংলাদেশে/চট্টগ্রামে রক্তক্যান্সার চিকিৎসার সুযোগ কেমন?
উঃ আলহামদুলিল্লাহ আশাপ্রদ বাস্তবতা হল প্রায় সব ক্যান্সারেরই বিশেষ করে সব ধরনের রক্ত ক্যান্সারের চিকিৎসা বাংলাদেশে এমনকি চট্টগ্রামেই হয়। বাংলাদেশের সম্মানিত রক্তরোগ ও রক্তক্যান্সার বিশেষজ্ঞ স্যারগণ অনেকেই বিদেশে কাজ করেছেন, ট্রেনিং করেছেন, দেশে কাজ করে বিদেশে সম্মানিত হচ্ছেন। অনেকেই দেশের মায়ায় বিদেশ যাওয়ার লোভনীয় অফার বাদ দিয়েছেন। দেশের লাখ লাখ মানুষকে চিকিৎসা দিয়ে বিদেশে বিভিন্ন গবেষণায়, সেমিনারে, ক্যান্সার চিকিৎসা ফোরামে সমাদৃত হচ্ছেন। দেশেই রক্তক্যান্সারের বেশিরভাগ ওষুধ উৎপাদন হচ্ছে। সব ধরণের রক্ত উপাদানও দেশেই/চট্টগ্রামেই পাওয়া যায়। তাই ইনশা আল্লহ চট্টগ্রামেই তথা বাংলাদেশে রক্তক্যান্সারের চিকিৎসা সম্ভব। বর্তমানে অনেক সম্মানিত রোগীই চট্টগ্রামে রক্তক্যান্সারের চিকিৎসা নিচ্ছেন ও ভাল আছেন।
রক্তক্যান্সারের চিকিৎসা নিজ শহরে/নিজ দেশে করলে সুবিধা কি?
উঃ ব্যয়বহুল ও দীর্ঘ সময় নিয়ে ক্যান্সারের চিকিৎসা দেশে নিলে অন্তত বিদেশে আসা যাওয়া থাকা খাওয়ার বিশাল খরচ, কালচারাল সোশাল ভাষাগত ও ধর্মীয় নানা সমস্যা, পাসপোর্ট ভিসা বা টাকা পাঠানোর জটিলতা, বাড়তি খরচ এসব থেকে মুক্ত থাকা যায়। বিদেশের সব চিকিৎসাই মান সম্পন্ন আর বিদেশের ডাক্তার মানেই ফেরেশতা এসব খুব ভুল ধারণা যা অনেক রোগীর অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বুঝতে পারি। অনেক রোগীই নানা মানুষের কথায় জায়গা জমি বিক্রি করে বিদেশ যান। ওখানে কিছুদিন চিকিৎসা করে অর্থাভাবে দেশে ফিরে আসেন। অথচ দেশে থাকলে চিকিৎসা খরচের বাইরে আনুষঙ্গিক খরচটাও চিকিৎসার কাজে লাগানো যেত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেশে চিকিৎসার খরচও বিদেশ থেকে কম হয়। বাস্তবতা হল পৃথিবীর সব দেশেই রক্ত ক্যান্সারের চিকিৎসা একই। কেমোথেরাপি বা ট্রান্সপ্লান্ট। এর বাইরে খুব বেশি কিছু নেই। দেশে নিজ শহরে চিকিৎসা নিলে রোগীর জন্য রক্ত জোগাড় করা তূলনামূলকভাবে অনেক সহজ হয়ে যায়। পরিচিত পরিবেশে আপনজনদের মাঝে রোগী তূলনামূলকভাবে স্বস্তিতে থাকেন। আত্মীয় স্বজনরাও রোগীর পাশে থেকে পর্যাপ্ত সাপোর্ট দিতে পারেন। সব মিলিয়ে নিজ শহরেই চিকিৎসা নেয়া অনেক সুবিধাজনক।
রক্তক্যান্সার নিয়ে একজন সম্মানিত বিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে সমাজের প্রতি আপনার বার্তা কি?
উঃ পৃথিবীর সব দেশেই রক্তক্যান্সার নিয়ে যুদ্ধ চলছে। আমাদের দেশও এর বাইরে নয়। আমাদের দেশের সম্মানিত চিকিৎসকগণ একপ্রকার ব্যক্তিগত উদ্যোগেই এ যুদ্ধের একমাত্র সৈনিক হিসেবে নিয়োজিত আছেন বলা যায় এবং অনেক ক্ষেত্রেই আমরা সাফল্যের সাথেই রক্তক্যান্সারের চিকিৎসা করছি আলহামদুলিল্লাহ আল্লহুম্মা বারিক । দেশেই এখন বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টও হচ্ছে। তবে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে জিততে হলে গোটা সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে এ যুদ্ধে রোগীর যেমন বিশাল একটি সহযোগিতা দরকার হয় তেমন সহযোগিতা দরকার হয় সম্মানিত চিকিৎসকগণেরও। আপনি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসুন। আপনার দুটি সঠিক কথা, সহমর্মিতা, অর্থনৈতিক সাহায্য, অনেক দুআ আর অবশ্যই হুজুগে ভুল পরামর্শ বা অবাস্তব সমালোচনা থেকে দূরে থাকা রোগী, তাঁর পরিবার আর সমাজকে কঠিন রক্তক্যান্সারের বিরুদ্ধে অনেক দূর এগিয়ে দেবে। আপনার শহরের মানুষের জন্য এগিয়ে আসুন। এগিয়ে আসুন আপনার দেশের জন্য। আমরা মহান আল্লহর উপর ভরসা করে অর্জিত জ্ঞ্যান মেধা আর চেষ্টা নিয়ে আপনাদের পাশেই আছি।
Last Updated on 26/10/2021 by Kamrul Hasan
আমি আহসানিয়া মিশন,কামারপাড়া-তুরাগ-ঢাকা তে চিকিত্সা নিচ্ছি এখানে কি ভালো চিকিত্সা হবে না?রুগির বয়স 5 বছর 8 মাস ।T-All.
রোগীর কি অবস্থা এখন?? সুস্থ হয়েছে?