থ্যালাসেমিয়া : একটি ঘুমন্ত বিস্ফোরক
লিখেছেন ডা. মুহাম্মাদ জামাল উদ্দীন তানিন।
বাচ্চাটার কদিন ধরেই শরীর ভাল না। কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। খেলেই বমি করে। পেটের ভিতর কি যেন ফুলে আছে আর জন্ডিস। দিন দিন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে। ছয় মাস বয়সের বাচ্চার এমন কিছু হলে বাবা মায়ের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। তেমনি আকাশ ভেঙ্গে পড়ল আসিফ আর শারমিন দম্পতির মাথায়। দুজনেই শিক্ষিত। তাই বিজ্ঞ একজন ডাক্তারের কাছে যেতে দেরি হল না। শিশুরোগের ডাক্তার সাহেব কিছু পরীক্ষা দিলেন। পরদিন রিপোর্ট দেখেই ডাক্তার সাহেব দ্রুত রক্তরোগের সম্মানিত বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে যেতে বললেন। সেখানেই আসিফ আর শারমিন প্রথম শুনলেন থ্যালাসেমিয়া নামের রোগ হয়েছে ওদের বাচ্চার।
এখন থেকে নিয়মিত রক্ত দিতে হবে। কখনো মাসে মাসে কখনো সপ্তাহে সপ্তাহে। আবার দামি কিছু ওষুধও খেতে হবে সারাজীবন। এমনকি ডাক্তার মহোদয় এটাও বললেন যে ওদের পরের সন্তানেরও এই রোগ হতে পারে। কান্না শুরু করল শারমিন। নির্বাক হয়ে রইল আসিফ। একটু পরে জানতে চাইল আসিফ এ রোগ কিভাবে হল?! ডাক্তার সাহেব বললেন, বংশগত। তখনই ওরা অবাক। কই ওদের বংশেতো এই রোগ নেই।
চেম্বারে নানা রোগীর ভিড়। কিছু বয়স্ক লোকও আছেন। রোগীরা দেরি দেখে বিরক্ত হচ্ছেন। তাই উসখুশ করছিল সম্মানিত ডাক্তার সাহেবের এটেন্ডেন্ট। তাই থ্যালাসেমিয়া নিয়ে একটি বই দিলেন ডাক্তার সাহেব ওদের। সেখান থেকেই কিছু কথা…
সহজভাবে বললে থ্যালাসেমিয়া রোগটা রোগীর শরীরে দু’ভাবে থাকে। একটি হল বাহক অবস্থা আর আরেকটি হল আক্রান্ত অবস্থা। একজন বাহকের শরীরে বাহ্যিক কোন লক্ষণ থাকে না। ঠিক সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ এর মতই সব কিছু। একেবারেই বোঝার কোন উপায় নেই যে, উনি বাহক। কিন্তু শরীরে থ্যালাসেমিয়া রোগের জিন ক্রোমোসোমে লুকিয়ে থাকে কোন ক্ষতি ছাড়াই। পুরুষ মহিলা উভয়ই বাহক হতে পারেন। আর রোগাক্রান্ত ব্যক্তির লক্ষণ হল শরীরে রক্ত কমে যাওয়া, ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, পেট ফুলে যাওয়া, জন্ডিস হওয়া, হাড় বাঁকা হয়ে যাওয়া, কিছুদিন পর পর রক্ত দিতে হওয়া ইত্যাদি।
আমাদের সমাজে মহিলা পুরুষ উভয়ের মধ্যেই থ্যালাসেমিয়ার বাহক অনেক। এখন একজন বাহকের সাথে যখন আরেকজন বাহকের বিয়ে হয় তখনই হয় সমস্যা। যেহেতু বাহকের বাহ্যিক কোন সমস্যা বা রোগের লক্ষণ থাকে না তাই ঠিক ঠাক বিয়ে হয়, বিয়ের পর সন্তান হয়। এখন বাহক বাবা ও বাহক মা থেকে সন্তান যখন দুটি বাহক জিন পেয়ে যায়, তখন সন্তান আর বাহক থাকে না। সে হয়ে পড়ে রীতিমত একজন থ্যালাসেমিয়া রোগী।
আর একারণেই বাহক পিতামাতা বার বার বলেন যে তাদের বংশে তো এই রোগ নেই। বাস্তবতা হল বংশে এই রোগ ঠিকই ছিল। কিন্তু বাহক অবস্থায় ছিল বলে তা আর বোঝা যায়নি। কারণ বাহকের কোন বাহ্যিক লক্ষণ নেই। অথচ সন্তানকে নিয়ে তারা এখন বিশাল ভুক্তভোগী। কারণ, ব্যয়বহুল বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট ছাড়া এই রোগ সম্পূর্ণরূপে কখনো সেরে যাবে না। তাই সারাজীবন রক্ত, ঔষধ, টেস্ট এর জন্য হাসপাতাল-ক্লিনিকে ছোটাছুটি ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই।
তাহলে উপায় কি? উপায় কিন্তু খুব সহজ। এমনকি অন্য সব রোগের চিকিৎসা হয় রোগ হবার পর। কিন্তু থ্যালাসেমিয়ার আসল চিকিৎসা হল রোগ হওয়ার আগেই রোগ ঠেকিয়ে দেওয়া।
সেটা কিভাবে?
খুব সহজ। বাহকের সাথে বাহকের বিয়ে ঠেকানোর মাধ্যমে। বিয়ের আগেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মাধ্যমে রক্ত পরীক্ষা করে জানতে হবে পাত্র ও পাত্রী থ্যালাসেমিয়ার বাহক কিনা। বাহকের সাথে যদি এমন একজন মানুষ এর বিয়ে হয় যিনি বাহক নন তাহলেই বাচ্চার আর থ্যালাসেমিয়া হবে না। আর বাহককে বিয়ে করতে যিনি বাহক নন তার কোন সমস্যাই নেই। কারণ চিকিৎসাবিজ্ঞানের চোখে বাহকের কিন্তু কোন সমস্যা নেই। তাই বাহককে অসুস্থ বলার কোন সুযোগ নেই। সমস্যা কেবল তখনই হবে যখন বাহকের সাথে বাহকের বিয়ে হবে।
অনেক দেশেই এই থ্যালাসেমিয়া রোগ আর দেখা যায় না। কিন্তু অতীতে এই রোগ সেখানে খুব প্রকট ছিল। শুধু বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে সেসব দেশের মানুষ জেনে নিয়েছেন যে তাদের মধ্যে কে বাহক আর কে বাহক নন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আর পুরো সমাজ সেখানে থ্যালাসেমিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছেন। তারপর কখনো আইন করে আর কখনো নিজ উদ্যোগেই সচেতন হয়ে তারা নিশ্চিৎ করেছেন বিয়ের কনে বা বর থালাসেমিয়ার বাহক কিনা সেটা জানা থাকতে হবে। আর যত যাই হোক একজন বাহক কখনোই আরেকজন বাহকের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবেনা। বরং কোন সমস্যা ছাড়াই একজন বাহক এমন আরেকজনকে বিয়ে করবেন যিনি বাহক নন। এই ছোট্ট একটি কাজ, বিয়ের আগে বিশেষজ্ঞ এর মাধ্যমে নিজের রক্ত পরীক্ষা আর একটু সচেতন হয়ে পাত্র-পাত্রীর রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট জেনে নিলে আমাদের সমাজও হতে পারে থ্যালাসেমিয়া মুক্ত। থ্যালাসেমিয়া হল একটি ঘুমন্ত টাইম বোমা বা বিস্ফোরক। তবে এর বিস্ফোরণ ঘটে সন্তানের উপর। বাবা মায়ের একটু অসচেতনতার জন্য সারাজীবন রোগযন্ত্রণা ভোগ করে তাদেরই আদরের সন্তান। এ ব্যাপারে তরুণ সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই আমরা নিশ্চিত করতে পারব এমন পরিবার যেখানে থ্যালাসেমিয়ার মত একটি কষ্টদায়ক অনিরাময়যোগ্য রোগ পরিবারকে কুরে কুরে খেয়ে ফেলবেনা। আসুন সবাই মিলে চেষ্টা করি। থ্যালাসেমিয়ামুক্ত পরিবার তথা সমাজ গড়ে তুলি।
Last Updated on 23/08/2020 by Dr. Khaza Amirul Islam
খুব সুন্দর আর্টিকেল হয়েছে। আমি একটু যোগ করতে চাই। বাহকে বাহকে বিয়ে যদি হয়েই যায় তাহলে বাচ্চা নেয়ার আগে অন্তত থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা করা জরুরী। যদি উভয়েই বাহক হয় তাহলে আর্লি প্রিনেটাল টেস্টিং করার সুবিধা এখন দেশে আছে। গর্ভস্থ ভ্রূণ আক্রান্ত হয়ে থাকলে সেই ভ্রূণ নষ্ট করার উপদেশ দেয়া হয় যা দেশের এবং মুসলিম আইনে নিষিদ্ধ নয়।
স্যার,আমার সন্তান এই রোগে আক্রান্ত।আমি সামান্য চাকুরীজীবি।আমার দ্বারা এই ব্যয়বহুল চিকিৎসা করা অসম্ভব হয়ে দাড়িয়েছে।আমি কি আপনাদের দ্বারা কোন সহযোগিতা পেতে পারি।