থ্যালাসেমিয়া রোগের উত্তরাধিকার
পিতা-মাতা দুজনেই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে সন্তানদের ২৫% সম্ভাবনা থ্যালাসেমিয়া রোগ হওয়ার, ছবির মত সরল এই Mendelian inheritance pattern বুঝতে তেমন কারো অসুবিধা হবার কথা নয়। থ্যালাসেমিয়ার প্রধান দুই প্রকরনের মধ্যে বিটা থ্যালাসেমিয়াকে এই প্যাটার্ন দিয়ে যত সরল ভাবে বুঝা যায় আলফা থ্যালাসেমিয়াকে ঠিক ততটা নয়। তবে বিশ্বব্যাপীই আলফা থ্যালাসেমিয়ার বাহক সংখ্যা বিপুল হলেও রোগী তুলনামূলক কম, যা বাংলাদেশে নিতান্তই বিরল। এছাড়া আলফা থ্যালাসেমিয়া রোগ, যার নাম Hemoglobin H disease, তার রোগলক্ষনও তুলনামূলক মৃদু, তীব্রতার মাত্রা বিচারে যেটিকে thalassemia intermedia বা মাঝারী মাত্রার থ্যালাসেমিয়ার কাতারে ফেলা যায়। অপরদিকে বিটা থ্যালাসেমিয়া বা অনুরূপ ধরনের থ্যালাসেমিয়া রোগ লক্ষনের তীব্রতার বিচারে মারাত্মক (thalassemia major) বা মাঝারি মাত্রার (thalassemia intermedia) উভয়ই হতে পারে এবং বলাই বাহুল্য যে বাংলাদেশে মূলত এই গোত্রের থ্যালাসেমিয়ারই প্রাদুর্ভাব। তবে বিটা থ্যালাসেমিয়া বা অনুরূপ রোগের ক্ষেত্রে সাধারনভাবে যে ‘বাহক’ শব্দটি আমরা বহুল ব্যবহার করি তা সবসময কোন নির্দিষ্ট একটি বৈশিষ্ট্য (trait) নয়। পিতা-মাতার মধ্যে এরূপ কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি বিপরীত লিঙ্গের অনুরূপ বৈশিষ্টের সম্মিলনে সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রোগের কারন হতে পারে। এরূপ কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের সাথে কোন্ কোন্ বৈশিষ্ট্যের সম্মিলনে কী ধরনের থ্যালাসেমিয়া হতে পারে, তা সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করছি। উল্লেখ্য যে, প্রানীর কোন genetic বৈশিষ্ট্যের বিচ্যুতি তার পিতা মাতা থেকে পাওয়া এক জোড়া জিন-এর একটিতে থাকলে সেটাকে trait বলে।
১) Haemoglobin E trait (HbE trait):
বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়া রোগের সাথে সংশ্লিষ্ট বৈশিষ্টের মধ্যে এটি সবচেয়ে বেশী (৪% – ৭%)। এটি মূলত থ্যালাসেমিয়া নয় বরং বিটা গ্লোবিন অনুর একটি পরিবর্তন ঘটিত পরিবর্তিত (variant) হিমোগ্লেবিন যা স্বাভাবিকের হিমোগ্লোবিন অনুর মতই কার্যকর। তবে কার্যকর হলেও এই বৈশিষ্টের হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিকের চেয়ে একটু কম মাত্রায় তৈরী হয় বিধায় এটি অতি মৃদু মাত্রার বিটা থ্যালাসেমিয়ার মত আচরন করে, ফলে বিটা বা অনুরূপ থ্যালাসেমিয়ার বাহকের সাথে মিলে থ্যালাসেমিয়া রোগ ঘটায়।
i. HbE trait + beta thalassemia trait= সন্তানদের ২৫ % সম্ভাবনা HbE/beta thalassemia হওয়ার, যা চারিত্রিকভাবে মোটের উপর একটু কম মাত্রার হলেও beta thalassemia রোগেরই অনুরূপ। বাংলাদেশের অধিকাংশ থ্যালাসেমিয়া রোগী এই ধরনের।
ii. HbE trait + delta-beta thalassemia trait= সন্তানদের ২৫% সম্ভাবনা HbE/delta-beta thalassemia হওয়ার, যার চরিত্র মোটামুটি হুবহু HbE/ beta thalassaemia রোগের মত।
iii. HbE trait + Hb-Lepore trait= সন্তানদের ২৫% সম্ভাবনা HbE/Hb-lepore রোগের, যার চরিত্রও কম বেশী Hb E/beta thalassemia এর মতই প্রায়।
iv. HbE trait + HbE trait= ২৫% সম্ভাবনা homozygous HbE, যেটিকে সাধারনভাবে HbE disease বলা হলেও বিজ্ঞানীরা এখন সচেতনভাবেই এই ক্ষেত্রে ‘disease’ শব্দটি পরিহার করেন। কারন এটি রোগ নয় বরং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে থ্যালাসেমিয় মাইনর বা beta thalassemia trait এর অনুরূপ। উল্লেখ্য, কোন genetic বৈশিষ্ট্য একজোড়া জিনের উভয় কপিতে থাকলে তাকে homozygous বলে।
২) Beta thalassemia trait:
সংখ্যার বিচারে এটি বাংলাদেশে HbE trait এর চেয়ে কম হলেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারন এটির সাথে মিলে ছাড়া শুধু HbE কোন থ্যালাসেমিয়া ঘটায় না (১.iv. দ্রষ্টব্য)।
i. Beta trait + beta trait= সন্তানদের ২৫% সম্ভাবনা beta thalassemia রোগের, যার অধিকাংশই মারাত্মক (thalassemia major) ও কিছু সংখ্যক মাঝারি মাত্রার (thalassemia intermedia).
ii. Beta trait + HbE trait= সন্তানদের ২৫% সম্ভাবনা HbE/beta thalassemia হওয়ার (১.i অনুরূপ) ।
iii. Beta trait + delta-beta trait= সন্তানদের ২৫% সম্ভাবনা Beta/delta-beta thalassemia রোগ হবার। এটা মোটামুটি হুবহু beta thalassemia রোগের মতই এবং সাধারন রক্ত পরীক্ষায় (CBC ও haemoglobin electrophoresis) পরীক্ষা করে এটিকে beta thalassemia রোগ থেকে আলাদা করা শক্ত। চিকিৎসার প্রয়োজনে এই পার্থক্য নির্ধারন আবশ্যকও নয়। তবে এটি pre-natal বা গর্ভস্থ শিশুর থ্যালাসেমিয়া নির্নয়ে একটি বড় চ্যালেঞ্জ, কারন খুব কম ল্যাবরেটরিই delta-beta thalassemia এর জেনেটিক পরীক্ষা করে।
iv. Beta trait + Hb-Lepore trait= সন্তানদের ২৫% সম্ভাবনা Hb-Lepore/beta thalassemia trait হওয়া, যা তীব্রতার বিচারে beta thalassemia রোগেরই মত।v. Beta trait + HbS trait= ২৫% সম্ভাবনা সন্তানদের HbS/beta thalassemia হওয়ার। এটির নামের শেষ thalassemia দিয়ে হলেও এটি মূলত একটি sickling disease. যারা থ্যালাসেমিয়াসহ হিমোগ্লোবিনের জন্মগত সমস্যার বৈশ্বিক খবর মোটামুটি রাখেন তারা জানেন যে beta thalassemia রোগের পরেই sickle cell disease/syndrome ২য় গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। তবে সুখের কথা এই যে বাংলাদেশে এই সমস্যা বিরল।
৩) Homozygous Hb E বা HbE/E:
এটি সংজ্ঞা অনুযায়ী trait না হলেও লক্ষনহীন thalassemia minor এর মত (১.iv. দ্রষ্টব্য) আচরন হওয়ায় সমাজে একজন সম্ভাব্য থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক এবং এটি একজন HbE trait এর তুলনায় দ্বিগুন থ্যালাসেমিয়া রোগের ঝুঁকি আরোপ করে সন্তানদের মধ্যে।
i. HbE/E + beta thalassemia trait= সন্তানদের ৫০% সম্ভাবনা HbE/beta thalassemia হওয়ার (১.i অনুরূপ)।
ii. HbE/E + delta-beta trait= ৫০% সম্ভাবনা সন্তানের HbE/delta-beta thalassemia হওয়ার (১.ii অনুরূপ)।
iii. HbE/E + Hb-Lepore trait = ৫০% সম্ভাবনা HbE/Hb-lepore disease হওয়ার, যার মধ্যে থ্যালাসেমিয়া সরাসরি কোন genetic বৈশিষ্ট্য না থাকা সত্বেও মোটামুটি beta thalassemia রোগের মতই লক্ষন তৈরী করে।
৪) Delta-beta thalassemia trait:
এটি আমাদের দেশে বিরল হলেও দুঃস্প্রাপ্য নয়। এরা beta thalassemia trait এর মতই thalassemia minor হিসেবে আচরন করে। ভুল করে haemoglobin electrophoresis রিপোর্টে অনেকেই এটিকে hereditary persistence of fetal hemoglobin (HPFH) হিসেবে চিহ্নত করেন। HPFH একেবারেই নির্দোষ একটি অবস্থা বিধায় এধরনের ভুল বিপজ্জনক।
i. Delta-beta trait + beta trait= ২৫% সম্ভাবনা Beta/delta-beta thalassemia রোগ হওয়ার (২.iii দ্রষ্টব্য)
ii. Delta-beta thalassemia trait + delta-beta thalassemia trait= সন্তানদের ২৫% সম্ভাবনা delta-beta thalassemia রোগ হবার, যা রোগ লক্ষন অনুযায়ী beta thalassemia রোগের অনুরূপ এবং সাধারন পরীক্ষা নিরীক্ষায় এটিকেও beta thalassemia থেকে আলাদা করা দুঃসাধ্য। চিকিৎসার প্রয়োজনে সেই পার্থক্য বিবেচ্যও নয়।
iii. Delta-beta trait + HbE trait= ২৫% সম্ভাবনা HbE/delta-beta thalassemia রোগের (১.ii অনুরূপ) iv. Delta-beta trait + Hb-Lepore trait= ২৫% সম্ভাবনা Hb-Lepore/delta-beta thalassemia রোগের যা Hb-Lepore/beta thalassemia বা beta thalassemia রোগের অনুরূপ।
৫) Hb-Lepore:
Hb-Lepore trait কে অনেকেই HbD-Punjab trait বলে ভুল করে। তবে এ’দুটি একেবারেই ভিন্ন বৈশিষ্ট- প্রথমটি beta thalassemia minor এর মত আর ২য় টি তে রক্তের মাত্রা থাকে একেবারেই স্বাভাবিক। তবে এটি জিনগত বৈশিষ্ট্যে থ্যালাসেমিয়া নয়, বরং HbE এর মত, একটি পরিবর্তিত হিমোগ্লোবিন। HbE এর মত এটিও beta thalassemia চরিত্রযুক্ত একটি পরিবর্তিত হিমোগ্লোবিন। তবে এটির তীব্রতা HbE এর চেয়ে বেশী। এটিও দেশে বিরল তবে দুষ্প্রাপ্য নয়।
i. Hb-Lepore trait + Hb Lepore trait= ২৫% সম্ভাবনা homozygous Hb-Lepore বা Hb-Lepore disease হওয়ার যা beta thalassemia রোগের মত, homozygous Hb E এর মত রোগ লক্ষনহীন নয়।
ii. Hb-Lepore trait + beta trait= ২৫% সম্ভাবনা Hb-Lepore/beta thalassemia রোগের (২.iv অনুরূপ)।
iii. Hb-Lepore trait + Hb E trait= ২৫% সম্ভাবনা Hb E/Hb-Lepore রেগের (১.iii অনুরূপ)।
এগুলোই হচ্ছে বাংলাদেশে আমার দেখা থ্যালাসেমিয়া ও অনুরূপ সমস্যাজনিত থ্যালাসেমিয়া রোগের inheritance এর ধরন। Haemoglobin S বাংলাদেশে বিরল এবং Hb S এর অনুপস্থিতিতে Haemoglobin D-Punjab একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক বিধায় এ’দুটি নিয়ে আলোচনা এখানে পরিহার করলাম।
Last Updated on 05/08/2021 by Editorial Staff
Comments
থ্যালাসেমিয়া রোগের উত্তরাধিকার — No Comments
HTML tags allowed in your comment: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>