থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধঃ রাস্তা নয় সোজা
লিখেছেন ডাঃ অখিল রঞ্জন বিশ্বাস
সময়টা ঠিক মনে নেই। সম্ভবতঃ ২০১০ সাল হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানিজ্য অনুষদে থ্যালাসেমিয়া বাহক সনাক্তকরনে একটি ছোটখাটো প্রোগ্রাম করেছিলাম আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজের হেমাটোলজি বিভাগ থেকে। আয়োজনটির মূল উদ্যোক্তা ছিলেন ঐ অনুষদেরই ছাত্র, রুশো ডাকনামের এক থ্যালাসেমিয়া রোগী ও তাঁর এক বান্ধবী। বান্ধবী মানে friend, girl friend নয়, নামটা তাঁর ঠিক মনে নেই তাই আজকের এই বর্ণনার জন্য তাঁর নামটা ধরে নিই ‘বেলা’ । আমাদের দিক থেকে মূল উদ্যোক্তা ছিলেন, তখন আমার ঘনিষ্ট সহকর্মী বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী, ডাঃ মিজানুর রহমান (শাওন)।
যাহোক, মূল বিষয় হচ্ছে,
আমরা মোটামুটি সবাই জানি যে থ্যালাসেমিয়া বাহক শনাক্তকরনের উদ্দেশ্য হচ্ছে
দুই জন বাহক নারী-পুরুষের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক নিরুৎসাহিত করা, যাতে
থ্যালাসেমিয়া রোগাক্রান্ত শিশুর জন্ম না হয়। তো সেই কার্যক্রমে
ছাত্র-ছাত্রীদের সংগৃহীত রক্ত নমুনা পরীক্ষা করার আগেই বেলাকে কিছুটা
কৌতুহল আর কৌতুকের সুরে জিজ্ঞেস করলাম, (যদিও বিষয়টি কৌতুককর নয় বরং
রীতিমত সিরিয়াস) “মনে কর তুমি থ্যালাসেমিয়া জাতীয় বৈশিষ্টের বাহক নও,
এমন ক্ষেত্রে গানিতিক হিসেবে, তোমার জীবনসঙ্গী হিসেবে প্রথম পছন্দ হওয়া
উচিৎ কি থ্যালাসেমিয়ার বাহক নন এমন একজন পুরুষ নাকি একজন থ্যালাসেমিয়া
বৈশিষ্টের বাহক?”
“একজন থ্যালাসেমিয়া বৈশিষ্ট্যের বাহক” তাঁর উত্তরটি
ছিল সত্যিই বুদ্ধিদীপ্ত এবং সঠিক। তাঁর উত্তরটি কেন সঠিক ছিল, গাণিতিক
সম্ভাব্যতার সূত্র অনুযায়ী, তা সহজে বোঝার জন্য আমরা তাঁর উত্তরের
বিপরীতটাকে সঠিক ধরে দেখি কী ঘটে- স্কুলে কোন কোন জ্যামিতিক উপপাদ্য
প্রমানের মত।
ধরুন বেলা বা অন্য যারা থ্যালাসেমিয়ার বাহক নন,
জীবনসঙ্গী হিসেবে তাদের প্রথম পছন্দ যদি হয় এমন কেউ যিনিও থ্যালাসেমিয়ার
বাহক নন, তবে এরকম মানুষগুলো মোটামুটি সবাই তাদের প্রথম পছন্দ (1st option)
অনুযায়ী স্বামী বা স্ত্রী পেয়ে যাবেন, গাণিতিক সম্ভাব্যতার সূত্রে। সে
ক্ষেত্রে একজন থ্যালাসেমিয়া বাহকের সম্ভাব্য জীবনসঙ্গী হিসেবে হাজির
থাকবেন আরেকজন সম্ভাব্য থ্যালাসেমিয়া বাহক, যেটা প্রত্যাশিত নয়। কারন এমন
দম্পতির সন্তানদেরই ২৫% সম্ভাবনা থ্যালাসেমিয়া রোগী হবার। যেমনটি
একেবারেই অপ্রত্যাশিত, থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের জন্য, আমরা জানি।
ব্যবহারিক
ক্ষেত্রে পরিস্থিতি হয়তো এতটা কঠিন নয়। তবে বেলা যেমনটি বলেছিলেন, একজন
অ-বাহক (non carrier) হিসেবে জীবনসঙ্গী হিসেবে তাঁর প্রথম পছন্দ (choice)
হওয়া উচিৎ একজন বাহক (carrier); বাস্তব ক্ষেত্রে অতটা যৌক্তিক না হলেও
অন্তত একজন অ-বাহক ব্যক্তির একজন থ্যালাসেমিয়া বাহককে সম্ভাব্য স্বামী বা
স্ত্রী হিসেবে সহজভাবে মেনে নেওয়ার মানসিকতা দেখানোটাও যে কোন সমাজেই বেশ
বড় চ্যালেঞ্জ। অথচ এটা জরুরী দুটি কারনে- ১) থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুর
জন্ম ঠেকানো এবং ২) সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের থ্যালাসেমিয়া বাহকদের পূর্ণ
অধিকার নিশ্চৎ করা।
শুধু একজন পেশাজীবী হিসেবে নয়, এই দেশ ও সমাজের সাধারণ সদস্য হিসেবেও আমরা জানি একজন ‘থ্যালাসেমিয়া বাহক নন’ এমন ব্যক্তির জন্য একজন ‘বাহক’কে সম্ভাব্য স্বামী বা স্ত্রী হিসেবে সহজভাবে মেনে নিতে অস্বীকার করার সম্ভাবনা কতটা প্রবল। এমনতর সামাজিক/সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে থ্যালাসেমিয়া রোগ প্রতিরোধের লক্ষ্যে দুজন বাহকের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক পরিহার করার উদ্দেশ্যে ব্যাপক পরিসরে বাহকদেরকে চিহ্নিত করার আগে বা অন্তত একই সাথে এমন পদক্ষেপ নেওয়া জরুরী যাতে বাহকগন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে সমাজে সহজভাবে গৃহিত হন। সেই ‘পদক্ষেপ’ হতে পারে শিক্ষামূলক, প্রচারনামূলক, এমনকি প্রয়োজনে প্রনোদনামূলক বা আইনগতও হতে পারে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সাথে পৌনপৌনিক আলোচনা এবং pilot trial and error এর মাধ্যমে, সতর্কতার সাথে এমন পদক্ষেপসমূহ নির্বাচন করতে হবে। সেটা না করে সরাসরি ব্যাপকভাবে বাহক চিহ্নিতকরন কর্মসূচী নিলে সেটা ৭-৮ % বিটা থ্যালাসেমিয়া ও হিমোগ্লোবিন ই এর বাহক, যারা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের মানুষ হিসেবে বিবেচিত হবার অধিকার রাখে, তাদের জীবন যাত্রায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
সময়টা ঠিক মনে নেই। সম্ভবতঃ ২০১০ সাল হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানিজ্য অনুষদে থ্যালাসেমিয়া বাহক সনাক্তকরনে একটি ছোটখাটো প্রোগ্রাম করেছিলাম আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজের হেমাটোলজি বিভাগ থেকে। আয়োজনটির মূল উদ্যোক্তা ছিলেন ঐ অনুষদেরই ছাত্র, রুশো ডাকনামের এক থ্যালাসেমিয়া রোগী ও তাঁর এক বান্ধবী। বান্ধবী মানে friend, girl friend নয়, নামটা তাঁর ঠিক মনে নেই তাই আজকের এই বর্ণনার জন্য তাঁর নামটা ধরে নিই ‘বেলা’ । আমাদের দিক থেকে মূল উদ্যোক্তা ছিলেন, তখন আমার ঘনিষ্ট সহকর্মী বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী, ডাঃ মিজানুর রহমান (শাওন)।
যাহোক, মূল বিষয় হচ্ছে, আমরা মোটামুটি সবাই জানি যে থ্যালাসেমিয়া বাহক শনাক্তকরনের উদ্দেশ্য হচ্ছে দুই জন বাহক নারী-পুরুষের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক নিরুৎসাহিত করা, যাতে থ্যালাসেমিয়া রোগাক্রান্ত শিশুর জন্ম না হয়। তো সেই কার্যক্রমে ছাত্র-ছাত্রীদের সংগৃহীত রক্ত নমুনা পরীক্ষা করার আগেই বেলাকে কিছুটা কৌতুহল আর কৌতুকের সুরে জিজ্ঞেস করলাম, (যদিও বিষয়টি কৌতুককর নয় বরং রীতিমত সিরিয়াস) “মনে কর তুমি থ্যালাসেমিয়া জাতীয় বৈশিষ্টের বাহক নও, এমন ক্ষেত্রে গানিতিক হিসেবে, তোমার জীবনসঙ্গী হিসেবে প্রথম পছন্দ হওয়া উচিৎ কি থ্যালাসেমিয়ার বাহক নন এমন একজন পুরুষ নাকি একজন থ্যালাসেমিয়া বৈশিষ্টের বাহক?”
“একজন থ্যালাসেমিয়া বৈশিষ্ট্যের বাহক” তাঁর উত্তরটি ছিল সত্যিই বুদ্ধিদীপ্ত এবং সঠিক। তাঁর উত্তরটি কেন সঠিক ছিল, গাণিতিক সম্ভাব্যতার সূত্র অনুযায়ী, তা সহজে বোঝার জন্য আমরা তাঁর উত্তরের বিপরীতটাকে সঠিক ধরে দেখি কী ঘটে- স্কুলে কোন কোন জ্যামিতিক উপপাদ্য প্রমানের মত।
ধরুন বেলা বা অন্য যারা থ্যালাসেমিয়ার বাহক নন, জীবনসঙ্গী হিসেবে তাদের প্রথম পছন্দ যদি হয় এমন কেউ যিনিও থ্যালাসেমিয়ার বাহক নন, তবে এরকম মানুষগুলো মোটামুটি সবাই তাদের প্রথম পছন্দ (1st option) অনুযায়ী স্বামী বা স্ত্রী পেয়ে যাবেন, গাণিতিক সম্ভাব্যতার সূত্রে। সে ক্ষেত্রে একজন থ্যালাসেমিয়া বাহকের সম্ভাব্য জীবনসঙ্গী হিসেবে হাজির থাকবেন আরেকজন সম্ভাব্য থ্যালাসেমিয়া বাহক, যেটা প্রত্যাশিত নয়। কারন এমন দম্পতির সন্তানদেরই ২৫% সম্ভাবনা থ্যালাসেমিয়া রোগী হবার। যেমনটি একেবারেই অপ্রত্যাশিত, থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের জন্য, আমরা জানি।
ব্যবহারিক ক্ষেত্রে পরিস্থিতি হয়তো এতটা কঠিন নয়। তবে বেলা যেমনটি বলেছিলেন, একজন অ-বাহক (non carrier) হিসেবে জীবনসঙ্গী হিসেবে তাঁর প্রথম পছন্দ (choice) হওয়া উচিৎ একজন বাহক (carrier); বাস্তব ক্ষেত্রে অতটা যৌক্তিক না হলেও অন্তত একজন অ-বাহক ব্যক্তির একজন থ্যালাসেমিয়া বাহককে সম্ভাব্য স্বামী বা স্ত্রী হিসেবে সহজভাবে মেনে নেওয়ার মানসিকতা দেখানোটাও যে কোন সমাজেই বেশ বড় চ্যালেঞ্জ। অথচ এটা জরুরী দুটি কারনে- ১) থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুর জন্ম ঠেকানো এবং ২) সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের থ্যালাসেমিয়া বাহকদের পূর্ণ অধিকার নিশ্চৎ করা।
শুধু একজন পেশাজীবী হিসেবে নয়, এই দেশ ও সমাজের সাধারণ সদস্য হিসেবেও আমরা জানি একজন ‘থ্যালাসেমিয়া বাহক নন’ এমন ব্যক্তির জন্য একজন ‘বাহক’কে সম্ভাব্য স্বামী বা স্ত্রী হিসেবে সহজভাবে মেনে নিতে অস্বীকার করার সম্ভাবনা কতটা প্রবল। এমনতর সামাজিক/সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে থ্যালাসেমিয়া রোগ প্রতিরোধের লক্ষ্যে দুজন বাহকের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক পরিহার করার উদ্দেশ্যে ব্যাপক পরিসরে বাহকদেরকে চিহ্নিত করার আগে বা অন্তত একই সাথে এমন পদক্ষেপ নেওয়া জরুরী যাতে বাহকগন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে সমাজে সহজভাবে গৃহিত হন। সেই ‘পদক্ষেপ’ হতে পারে শিক্ষামূলক, প্রচারনামূলক, এমনকি প্রয়োজনে প্রনোদনামূলক বা আইনগতও হতে পারে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সাথে পৌনপৌনিক আলোচনা এবং pilot trial and error এর মাধ্যমে, সতর্কতার সাথে এমন পদক্ষেপসমূহ নির্বাচন করতে হবে। সেটা না করে সরাসরি ব্যাপকভাবে বাহক চিহ্নিতকরন কর্মসূচী নিলে সেটা ৭-৮ % বিটা থ্যালাসেমিয়া ও হিমোগ্লোবিন ই এর বাহক, যারা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের মানুষ হিসেবে বিবেচিত হবার অধিকার রাখে, তাদের জীবন যাত্রায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
Last Updated on 05/04/2020 by Editorial Staff
Comments
থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধঃ রাস্তা নয় সোজা — No Comments
HTML tags allowed in your comment: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>