ক্যান্সার নির্ণয়- বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটঃ অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ
লিখেছেন ডাঃ মোঃ হাফিজুর রহমান
বহু দিন ধ’রে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।
বিশ্বকবির প্রাগুক্ত পঙক্তিমালা আমরা সাধারণত জন্মভূমির অপার সৌকর্যের অবারিত হাতছানিকে অগ্রাহ্যপূর্বক বিদেশ-বিভূঁইয়ের নিসর্গ টানে সতত আকর্ষিত মনোভাব প্রকাশার্থে ব্যক্ত করে থাকি। কিন্তু কবিগুরুর এই চারণগুলি জীবন স্তবকের নানা স্তরে, নানা ক্ষেত্রে রূপকার্থে ব্যবহার করা যায়। বাংলাদেশের ক্যান্সার চিকিৎসা ব্যবস্থার কথাই উদাহরণ হিসেবে দেওয়া যেতে পারে। এদেশেই বিশ্বমানের, বিশ্বস্বীকৃত চিকিৎসাসেবা থাকা সত্ত্বেও আমরা গড্ডলিকা প্রবাহের মতো ছুটে বেড়াই সীমানার ওপারে, বিদেশের দ্বারে দ্বারে।
শুরুটা করা যাক রিতা রানীর (ছদ্মনাম) পরিবারের গল্প দিয়ে। সবে আঠারোতে পা দেওয়া এই তরুণীর শরীরে বাসা বেঁধেছে ব্লাড ক্যান্সার। দিশেহারা হয়ে গেলো রিতার পরিবার। গরীব এই পরিবার কিভাবে চালাবে চিকিৎসা খরচ। বন্দক রাখা হলো জমি, বিক্রি করা হলো ধানী জমি। তাও হলোনা- ধারকর্জ করতে করতে সর্বস্বান্ত বাংলাদেশের উত্তরের এই গরীব পরিবারটি। সহায় সম্বল বিক্রি করে ব্যয়বহুল এক চিকিৎসা ব্যয় মেটানো রিতার পরিবারের কাছে গোঁদের উপর বিষফোঁড়ার মতো দেখা দেয় রোগনির্ণয়ের কিছু জটিল পরীক্ষা। কারণ, এগুলো পাঠাতে হবে পাশের দেশ ভারতে। এতে খরচ যেমন বেশি, সময়ও লাগবে মাত্রাতিরিক্ত। অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হতে হয় রিতা ও তার পরিবারকে। কিন্তু যে পরীক্ষার জন্য রিতার রক্ত ভারত গেলো, সেই পরীক্ষা রিতার জন্মভূমি বাংলাদেশেই হচ্ছে। রিতার পরিবার সেই কথা জানতো না। আসলে কথাটা হলো, রিতাদের এই তথ্যগুলো জানানো হয় না। কিছুটা জানার অভাবে, আর অনেকটাই ইচ্ছাকৃত মনোভাবের কারণে। কথা তাই থেকেই যায়- এমনটা কেন হলো! আসলে, এরকমটা প্রায়ই হচ্ছে আমাদের দেশে। ক্যান্সারের মতো ভয়ানক রোগগুলোর করাল থাবায় প্রতি বছর প্রায় ৩.৪% জনগোষ্ঠী দারিদ্রসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। এককালের স্বাবলম্বী পরিবারগুলো আজ নিঃস্ব-রিক্ত, সাত-চালা বাড়ির গৃহস্থের সম্বল শুধুই কুঁড়েঘরের পাশে বাঁশ দিয়ে ঘেরা প্রিয়জনের ছোট্ট কবরখানা, শহরের মধ্যবিত্ত পরিবারটি আজ শহরতলীর নিম্নবিত্ত বাসিন্দা। কিন্তু কি কারণে হচ্ছে এমন…
বাংলাদেশে ক্যান্সার মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ছে। গ্লোবোকান ২০১৮-এর সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশে ফি বছর দেড় লাখেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ক্যান্সারে; মারা যাচ্ছে লাখের উপরে। যথা সময়ে চিকিৎসা না পাওয়া, চিকিৎসাসেবার উচ্চমূল্য আর সঠিক পরামর্শের অভাবে প্রাথমিক পর্যায়ে থাকা অনেক রোগীর ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে (যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে Metastasis বলে); পরিণতিতে অকালে প্রাণ হারাচ্ছে সম্ভাবনাময় কিছু জনগোষ্ঠী। সামষ্টিকভাবে বাংলাদেশে ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা শতকরায় খুবই কম; কিন্তু ব্যষ্টিকভাবে সংখ্যাটা ধীরে ধীরে বাড়ছে। ব্লাড ক্যান্সারের আছে নানা প্রকার, বিভিন্ন প্রভেদ। সঠিক চিকিৎসায় এই রোগের রোগীদের দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার নজির আমাদের বাংলাদেশেই আছে। ব্লাড ক্যান্সার থেকে বেঁচে ফেরা মানুষের সংখ্যাও একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো কোন পরিসংখ্যান না। যেকোনো রোগেই বিশেষত ক্যান্সারের ক্ষেত্রে দ্রুততম সময়ের ভিতর সঠিক চিকিৎসা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর চিকিৎসার উপক্রমণিকাতেই থাকে সঠিকভাবে রোগনির্ণয়ের উপযোগিতা। কিন্তু এখানেই বেশিরভাগ সময় ঘটে যায় বিপত্তি; কিছু ঘটে অজ্ঞাতসারে, কিছু আবার ঘটানো হয় রোগীর অজান্তে।
আইসিডিডিআর,বি- কলেরা ও ডায়রিয়া চিকিৎসার জন্য সর্বজনবিদিত একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা। অথচ এই সংস্থাটি আজ বহুধা বিভক্ত কাজে সদা ব্যস্ত। বিগত প্রায় এক দশক ধরে এখানে এক প্রকার নীরবেই হচ্ছে ব্লাড ক্যান্সারের আন্তর্জাতিক মানের কিছু জটিল রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা। সম্প্রতি এই তালিকায় যোগ হয়েছে আরো কয়েকটি পরীক্ষা ব্যবস্থা। যথাযথ প্রচার, প্রসারের অভাবে সেগুলো থেকে যাচ্ছে সাধারণ্যের জানার বাইরে। মানুষ যেমন চিকিৎসার জন্য বাইরে চলে যাচ্ছে, তেমনি রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষাগুলোও সীমানা পেরিয়ে চলে যাচ্ছে পাশের দেশ ভারতে। অথচ এই পরীক্ষাগুলোই আমাদের দেশে করা সম্ভব- অপেক্ষাকৃত অনেক কম খরচে, নির্ভুলভাবে অতি অল্প সময়ে।
আইসিডিডিআর,বির ইম্যুনো-হেমাটোলজি এন্ড ক্যান্সার বায়োলজি ল্যাবে চালু রয়েছে ব্লাড ক্যান্সার নির্ণয়ের বিভিন্ন পরীক্ষা; যেমন- ফ্লো সাইটোমেট্রি (Flow Cytometry), রিয়েল টাইম পিসিআর (RT-PCR), ফিশ (FISH) প্রযুক্তি। অত্যাধুনিক এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে অতি অল্প সময়ের মধ্যে নির্ভুলভাবে একাধিক ধাপে নির্ণয় করা হচ্ছে ব্লাড ক্যান্সারের মতো জটিল রোগ। যে পরীক্ষাগুলোর ফলাফল ভারতের লাল প্যাথের মতো ল্যাবগুলো থেকে আসতে ১০ থেকে ১৪ দিন সময় লাগছে, সেই পরীক্ষাগুলোই এখন বাংলাদেশে সম্ভব হচ্ছে মাত্র ২৪ ঘন্টার মধ্যে। আমরা জানি, ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসা খুব দ্রুত শুরু করা এর সুস্থতার প্রধানতম শর্ত। অথচ দেশেই আধুনিক ও সমমানের সেবা থাকা সত্বেও শত শত রক্তের নমুনা চলে যাচ্ছে লাল প্যাথ, SRL lab-এর মতো বিদেশী ল্যাবগুলোতে। অর্থলগ্নিও করতে হচ্ছে বেশি, আবার কালক্ষেপণও হচ্ছে ভয়ানকভাবে। কিন্তু এগুলো কেন সবার দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না! কারণ একাধিক…
১. আমাদের দেশের অনেক ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ আছেন যারা আইসিডিডিআর,বির ইম্যুনো-হেমাটোলজি এন্ড ক্যান্সার বায়োলজি ল্যাব সম্পর্কে সম্যকভাবে অবগত নন। আবার তাদের জানার প্রতি অনীহাও একটি কারণ।
২. ব্লাড ক্যান্সারের এই পরীক্ষাগুলো অন্যান্য সাধারণ পরীক্ষার মতো নয়। এগুলো কিছুটা ব্যয়বহুল, নির্ণয়ে কিছুটা সময় লাগে। সর্বোপরি, এই পরীক্ষাগুলো খুবই স্পর্শকাতর। ছোট্ট একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, শরীরের মজ্জা থেকে রক্তের যে নমুনা নেওয়া হয় সেটা ২৪ ঘন্টার ভিতর ফ্লো সাইটোমেট্রি করে ফেলতে পারলে সঠিক ফলাফল আসার সম্ভাবনা বহুগুণে বেড়ে যায়। কিন্তু রক্তের এই নমুনাগুলো যখন ভারতের লাল প্যাথ, হুভেল লাইফসায়েন্সের মতো ল্যাবে পাঠানো হয় তখন এর ফলাফল আসতে সপ্তাহ দুয়েক যে সময় লাগে তা তো আগেই বলেছি; কিন্তু এগুলো সেদেশের ল্যাবে পাঠাতেও সময় লেগে যায় দুই থেকে পাঁচদিন। ক্ষেত্রবিশেষে তা সপ্তাহ ছুঁয়ে যায় ভারতভূমিতে পৌঁছতে পৌঁছতে। এক্ষেত্রে নমুনার গুণগত মানের অনেক পরিবর্তন হয়।
৩. সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যঃ কিছু অসাধু চক্র অনৈতিক লাভের আশায় রক্তের এসব পরীক্ষার গতিপথ ঘুরিয়ে দিচ্ছে সীমান্তের ওপারে। এতে আদতে রোগীদের যে অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে সেদিকে যেন কারো নজর নাই। অন্যদিকে নিজেদের পছন্দমতো ল্যাবে রোগনির্ণয় করানোর স্বাধীনতা রোগী ও তার স্বজনদের সাধারণত থাকে না। আর এই সুযোগটাই অন্যায়ভাবে নেয় কিছু অসাধু চক্র। এতে করে রোগী যে তার মৌলিক স্বাস্থ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তাই শুধু নয়, বরং কষ্টার্জিত উপার্জনকৃত অর্থের অপব্যবহার ও পাচার হচ্ছে।
ব্লাড ক্যান্সার প্রাথমিক চিকিৎসায় ভালো হয়ে যায়। কিন্তু দ্রুততার সাথে রোগনির্ণয় করতে না পারলে সবকিছুই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। দেশের অর্থ বাইরে চলে যাচ্ছে সেই বিতর্কে নাই বা গেলাম; আমাদের দেশেই যদি ভারতের লাল প্যাথের মতো (ক্ষেত্রবিশেষে আরো ভালোভাবে) আন্তর্জাতিক মানের সেবা প্রদানে সক্ষম ল্যাব থাকে, তাহলে কেন এতো অর্থ আর সময়ের অপচয়; যখন এই দুটোই খুব দামী হয়ে যায় জীবনের প্রয়োজনে! শুরুতে বর্ণিত রবি ঠাকুরের স্ফুলিঙ্গ গ্রন্থের উপর্যুক্ত চরণপুঞ্জের আবেদন আজ কেবল নিসর্গসকাশে সীমিত নাই। আমাদের খুঁজতে হবে সত্যকে, খুঁজে বের করতে হবে সঠিক পথকে; পাঞ্জেরী হতে হবে সবাইকেই।
চির হিরণ্ময় হোক জীবন সত্যালয়ের আহ্বানে
Last Updated on 05/04/2020 by Editorial Staff
Informative post for the haematologists……we should do more tests regarding cancer diagnosis within the country so that our own country becomes more mature in diagnosis……..best wishes….