.:: কচু পাতার পানি আর পেঁপে পাতার রস ::.
লিখেছেন ডাঃ মু. জামাল উদ্দীন তানিন
‘কচু পাতার পানি’ কথাটা গ্রামে যাওয়ার ভাগ্য যাদের হয়নি, তারা বুঝবেন না। কচু পাতার উপর বৃষ্টির পানির ফোঁটা কিভাবে যেন পাতাকে না ভিজিয়ে নড়াচড়া করতে থাকে। আর তারপর টুপ করে পড়ে যায়। কোন কিছুর অস্থায়ীত্ব বোঝাতে তাই কচু পাতার পানি কথাটি বলা হয়।
আসল কথায় আসি।
সম্প্রতি ডেংগুর ভয়াবহ রূপ নিয়ে যখন দেশের সম্মানিত চিকিৎসকগণ যোদ্ধার মত লড়ে যাচ্ছেন; এর মধ্যেই নানা সুযোগ সন্ধানী লোকজন যার যার আখের গোছাতে ব্যাস্ত। তেমনি এক খবর দেখলাম ফেসবুকে যে পেঁপে পাতার পানি খেলে ডেংগু ভাল হয়ে যায় আর প্লেটলেট বেড়ে যায়। শেয়ার করছেন শিক্ষিত অশিক্ষিত সকলেই। এবারের ডেংগুর ভয়াবহ আক্রমন সমাজকে প্রচণ্ড নাড়া দিয়েছে। সরকারী হাসপাতালে ভীড় উপচে পড়ছে। বেসরকারী হাসপাতালও এগিয়ে এসেছে। ডেংগুর চিকিৎসা নিয়ে নিরন্তর গবেষণায় নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছেন চিকিৎসকগণ। ব্রেন, কিডনি, হার্ট, লিভার সবখানেই আঘাত হানছে ডেংগু। নিজেরাও রোগীর থেকে ডেংগু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি নিয়েও নতুন নতুন কমপ্লিকেশন ম্যানেজে ব্যস্ত নাওয়া-খাওয়া ভুলে কাজ করা ডাক্তারগণ। এর মধ্যে ‘পেঁপে পাতার রস’ এই ধরনের কথাগুলো বলে বা শেয়ার করে যারা জীবন মৃত্যুর দোলাচলে থাকা মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন তারা আসলে কারা? উদ্দেশ্য হয়তো ভালো। কিন্তু, পেঁপে পাতার রস খেয়ে রোগীর কোন ক্ষতি বা মৃত্যু হলে তার দায় কি ওনারা নেবেন?
মেডিক্যাল সেক্টরে একটি ঔষধ নিয়ে যুগের পর যুগ গবেষণা হয়। প্রথমে ইঁদুর জাতীয় প্রাণীর উপর গবেষণা হয়। তারপর খুব ছোট পরিসরে রোগাক্রান্ত মানুষ এর উপর গবেষণা করা হয়। সেখানে ঔষধের কোন খারাপ প্রতিক্রিয়া হলে সেই ঔষধ আর ব্যবহার হয় না। আর ফলাফল ভাল হলে আরও বড় পরিসরে গবেষণা হয়। যাতে নিশ্চিত হওয়া যায় ঔষধের মাত্রা, ক্ষতি এসব সম্পর্কে। অনেক সময় দেখা যায় এক বয়সের জন্য ঔষধ ভাল হলেও অন্য বয়সে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশি। ইউরোপের মানুষের রোগ ভাল হলেও একই ঔষধে আফ্রিকানদের রোগ ভাল হচ্ছে না। পুরুষদের জন্য যেই ডোজ সেটা মহিলাদের জন্য খারাপ। কিংবা রোগীর অজ্ঞাত বা জ্ঞাত কোন রোগ ঔষধের কারণে বেড়ে যাচ্ছে বা ঔষধকে কাজ করতে দিচ্ছে না। এতসব বিষয় গবেষণার পর ঔষধ বাজারে আসার পরও তার নতুন ক্ষতিকর প্রভাব আবিস্কার হয় আর অনেক ঔষধ নিষিদ্ধ হয়। ঠিক একইভাবে চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়েও চলছে নিরন্তর গবেষণা।
সোজা কথায় বললে ডাক্তারী অনেক জটিল এক ব্যাপার, জ্ঞানের এক মহাসাগর। ডাক্তারগণ বছরের পর বছর এই জ্ঞান সাগর সৈকতের নুড়ি নিয়েই খেলা করেন। এসবের মাঝে হঠাৎ কোন কোন গবেষণায় দেখা গিয়েছে ‘পেঁপে পাতার রস ডেঙ্গুর মহৌষধ’– এ জাতীয় প্রচার এ দেশের হুজুগে আবেগপ্রবণ রোগীদের চিকিৎসা কত জটিল করে দিচ্ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। একটা দু’টা গবেষণা মানেই রোগীকে ঔষধ গিলিয়ে দেওয়া যাবে ব্যাপারটা কখনোই তেমন নয়।
অবশ্য, যে দেশে এমবিবিএস পাস না করে ডাক্তারি করা যায় অথবা মেডিকেল এর আয়ারা চেম্বার খুলে বসে কিংবা ফার্মেসিওয়ালা হন বিশেষজ্ঞ সে দেশে এসব কথা অরণ্যে রোদন মাত্র।
ডেঙ্গু নিয়ে সবাই রাজনীতিতে ব্যস্ত, দায়িত্ব এড়াতে ব্যস্ত। কেউ কেউ করছেন মশা মারার নাটক আর মশার ঔষধের দাম বাড়াচ্ছেন লোভাতুরে ব্যবসায়ীরা। দুঃখজনকভাবে কেউ কেউ নিজেকে ভাইরাল করতে গিয়ে যুদ্ধের মাঠে ‘মীরজাফরের’ ভূমিকায় অবতীর্ণ। আর রোগীর অভিভাবকদের সাথে নিয়ে জীবনের ঝুঁকি উপেক্ষা করে ক্লান্তিকর সম্মুখযুদ্ধ করে যাচ্ছেন ডাক্তার ও নার্সগণ।
তাই, বুদ্ধিমান মানুষের উচিৎ সম্মানিত চিকিৎসকগণের কথাই শোনা। যাঁরা জীবনকে মূল্য দেন, তাঁরা যেন একটু সচেতন হন। নিজের, বাবা-মা, স্বামী-স্ত্রী বা সন্তানের জীবন যেন কচুপাতার পানি না হয়। বরং জীবন হোক সুন্দর বাগানের মত।
আল্লাহ আমাদের ভাল রাখুন।
Last Updated on 04/04/2020 by Editorial Staff
Comments
.:: কচু পাতার পানি আর পেঁপে পাতার রস ::. — No Comments
HTML tags allowed in your comment: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>