ইয়ে, বিয়ে, অতপর সন্তানাদি
লিখেছেন ডাঃ মুহাম্মদ কামরুজ্জামান
বিয়ের জন্য পাত্র বা পাত্রীর পরিবার পরিজন, আত্মীয় স্বজন সংক্রান্ত যাবতীয় খোঁজ খবর নিয়েছেন। কিন্তু স্বামী স্ত্রীর ব্লাড গ্রুপ কি হবে, দুইজনই থ্যালাসেমিয়ার বাহক কিনা, হিমোফিলিয়ার বাহক বা রুগী কিনা জেনে নিয়েছেন কি?
ক). থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রক্তস্বল্পতা জনিত রোগ। বাবা ও মা দুইজনই থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হলে সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রুগী হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
থ্যালাসেমিয়ার বাহক স্বাভাবিক মানুষরূপে বেড়ে ওঠে। তাই কেউ থ্যালাসেমিয়ার বাহক কি না, তা বাহ্যিকভাবে বুঝার কোন উপায় নাই।
আর থ্যালাসেমিয়া রুগী জন্মের পর ৬ মাস বয়স হতে ফ্যাকাসে হয়ে যায়, জন্ডিস দেখা দেয়। আস্তে আস্তে পেটের প্লীহা ও লিভার বড় হয়ে যায়। ঠিকমতো শরীরের বৃদ্ধি হয় না। রক্তস্বল্পতারর জন্য প্রতি মাসে ১ থেকে ২ ব্যাগ রক্ত শরীরে নিতে হয়। ঘন ঘন রক্ত নেওয়ায় ও পরিপাক নালী থেকে আয়রনের শোষণ ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় শরীরে আয়রনের মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে লিভার, হৃদপিন্ডসহ অন্যান্য অংগের নানা রকম মারাত্মক জটিলতা দেখা দেয়। সঠিক চিকিৎসা ও নিয়মিত রক্ত না নিলে থ্যালাসেমিয়া রুগী ৫ থেকে ৬ বছরের মধ্যে মারা যায়।
নিয়মিত রক্ত দিয়ে রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে সঠিক চিকিৎসা করালে থ্যালাসেমিয়া রুগীকে ২০ থেকে ৩০ বছর বাচানো সম্ভব। সঠিক চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয় বহুল তাই সবার পক্ষে চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব হয় না। অকালে ঝরে যায় হাজারও প্রাণ। পরিবারে আসে দরিদ্রতা।
বাংলাদেশের অনেকেই জানেনা তিনি থ্যালাসেমিয়ার বাহক কিনা। তাই অজান্তেই থ্যালাসেমিয়া বাহকের মধ্যে বিয়ে হচ্ছে এবং দিন দিন থ্যালাসেমিয়া রুগি বাড়ছেই।
বংশানুক্রমে সঞ্চারিত হয় কিভাবে?
১). বাবা-মা উভয়েই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে সন্তান থ্যালাসেমিয়ার রুগী হওয়ার সম্ভবনা শতকরা ২৫ ভাগ, বাহক হওয়ার সম্ভবনা শতকরা ২৫ ভাগ আর সুস্থ হওয়ার সম্ভবনা শতকরা ৫০ ভাগ।
২). বাবা-মা যেকোনো একজন থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে সন্তানের বাহক হওয়ার সম্ভবনা শতকরা ৫০ ভাগ, সুস্থ হওয়ার সম্ভবনা শতকরা ৫০ ভাগ আর থ্যালাসেমিয়া রুগী হওয়ার সম্ভবনা নাই।
তো তো ভাইবোনের (চাচাতো, মামাতো, খালাতো, ফুফাতো) মধ্যে বিয়ে এবং পরিবারের কারো থ্যালাসেমিয়া থাকলে থ্যালাসেমিয়া বাহক হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
কিভাবে জানা যাবে আপনি থ্যালাসেমিয়ার বাহক কি না?
Haematology Autoanalyzer মেশিনে CBC পরীক্ষায় (মাত্র ২০০-৫০০ টাকায়) যদি Haemoglobin near normal or normal, increased RBC number, MCV less than 80 fl, MCH less than 27 pgm, MCHC normal, RDW-CV normal (less than 15) হয়, তাহলে থ্যালাসেমিয়া বাহক হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। এরপর Haemoglobin Electrophoresis করে থ্যালাসেমিয়া বাহক কিনা নিশ্চিত হওয়া যাবে। তবে, ক্ষেত্রবিশেষ DNA analysis লাগে।
বাবা-মা থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে মায়ের পেটের বাচ্চা থ্যালাসেমিয়ার রুগী কিনা তা নিশ্চিত হয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ একটি অঘটন সারা জীবনের জন্য কান্না।
দুই জন থ্যালাসেমিয়া বাহকের মধ্যে বিয়ে বন্ধ করা গেলেই থ্যালাসেমিয়া রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
খ). স্বামী-স্ত্রীর ব্লাডগ্রুপ কি হওয়া উচিৎ?
স্বামীর ব্লাডগ্রুপ যদি পজেটিভ হয় তাহলে স্ত্রীর ব্লাডগ্রুপও পজেটিভ হতে হবে। আর যদি স্বামীর ব্লাডগ্রুপ নেগেটিভ হয় তাহলে স্ত্রীর ব্লাডগ্রুপ পজেটিভ বা নেগেটিভ যে কোনো একটি হলেই হবে। তবে স্বামীর ব্লাডগ্রুপ যদি পজেটিভ হয় তাহলে কোনোভাবেই স্ত্রীর ব্লাডগ্রুপ নেগেটিভ হওয়া চলবে না। এক্ষেত্রে যদি স্ত্রীর ব্লাডগ্রুপ নেগেটিভ হয় তাহলে তার স্বামীর ব্লাডগ্রুপও নেগেটিভ হতে হবে।
যদি স্বামীর ব্লাডগ্রুপ পজেটিভ হয় আর স্ত্রীর ব্লাডগ্রুপ নেগেটিভ হয় তাহলে কী সমস্যা হবে?
যদি স্বামীর ব্লাডগ্রুপ পজেটিভ হয় তাহলে সাধারনত বাচ্চার ব্লাডগ্রুপও পজেটিভ হবে। যখন কোনো নেগেটিভ ব্লাডগ্রুপের মা পজেটিভ গ্রুপের বাচ্চা ধারণ করে, তখন সাধারনত প্রথম বাচ্চার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু ডেলিভারির সময় বাচ্চার পজেটিভ ব্লাড মায়ের শরীরে প্রবেশ করবে আর যে ব্লাড প্রবেশ করবে, তা থেকে কয়েক মাসের মধ্যেই মায়ের শরীরে এন্টিবডি তৈরী করবে। মা যখন দ্বিতীয় সন্তান বহন করবে, তখন যদি তার পেটের বাচ্চার ব্লাডগ্রুপ পুনরায় পজেটিভ হয়, তাহলে মায়ের শরীরে আগের তৈরিকৃত এন্টিবডি বাচ্চার শরীরে প্রবেশ করবে। যার ফলে লোহিত রক্তকণিকা ভেঙ্গে যাবে এবং বাচ্চার রক্তস্বল্পতা, জণ্ডিস ও লিভার বড় হয়ে জন্মের সাথে সাথে মারা যাবে। যদি স্বামী-স্ত্রীর ব্লাডগ্রুপ বাচ্চা নেয়ার আগে জানা যায়, তবে এটা প্রতিরোধের জন্য কার্যকর ঔষধ আছে।
গ). হিমোফিলিয়া একটি রক্তক্ষরণজনিত জন্মগত রোগ যা বংশানুক্রমে ছেলেদের হয়ে থাকে। মেয়েরা হিমোফিলিয়া রোগের বাহক হয়।
হিমোফিলিয়া রুগীর খালাতো বোন, মামাতো বোন, খালা সাধারণত বাহক হন। তবে ক্ষেত্র বিশেষ মেয়েরাও রুগী হতে পারে। বাহকের ছেলে সন্তান রুগী হতে পারে।
ছেলে বাচ্চা যখন হাত-পা ছুড়তে থাকে, হামাগুড়ি দিতে শিখে তখন আপনা-আপনি হাটু, কুনূই, পায়ের গোড়ালী ফূলে যায় ও মাংসপেশীতে কালো কালো দাগ দেখা যায়। বাচ্চা প্রচন্ড কান্নাকাটি করে, হাত-পা ছুড়াছুড়ি ও খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়। খেলাধুলার সময় সামান্য আঘাতে মাংসপেশীতে কালো কালো দাগ পড়ে, গীড়া ফূলে যায়। দাত পড়লে রক্তপড়া বন্ধ হতে চায় না। সুন্নতে খৎনা করার সময় প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়।
বংশানুক্রমে সঞ্চারিত কিভাবে হয়?
১). যদি বাবা সুস্থ এবং মা বাহক হয় তবে ছেলে সন্তানের রুগী হওয়ার সম্ভবনা ৫০% আর মেয়ে সন্তানের বাহক হওয়ার সম্ভবনা ৫০%.
২). যদি বাবা রুগী এবং মা সুস্থ হয় তবে সমস্ত ছেলে সন্তানই সুস্থ হবে এবং সমস্ত মেয়ে সন্তানই বাহক হবে। সুতরাং প্রত্যেক হিমোফিলিয়া পুরুষ রুগী বিয়ে করতে পারবে, তবে সন্তান নেওয়ার সময় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের/রক্তরোগ বিশেষজ্ঞের উপদেশ নিতে হবে।
৩). যদি বাবা রুগী এবং মা বাহক হয় তবে ছেলে সন্তানের রুগী হওয়ার সম্ভবনা ৫০%. আর মেয়ে সন্তানের রুগী হওয়ার সম্ভবনা ২৫%, বাহক হওয়ার সম্ভবনা ২৫%.
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ ভূক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের genetic testing, genetic counseling and prenatal test (amniocentesis) করে অনাগত সন্তান রুগী না বাহক তা নিশ্চিত হয়ে হিমোফিলিয়ার আক্রান্তের সংখ্যা কমাতে পারে। আমাদের দেশেই এসব পরীক্ষা করা হচ্ছে।
হিমোফিলিয়া রোগকে একেবারে সারানোর কোন চিকিৎসা এখনও আবিষ্কার হয় নাই। তবে জীন থেরাপি গবেষণায় রয়েছে।
সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে যেমন: নিয়ম মাফিক বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত ফ্যাক্টর শিরায় ইঞ্জেকশন নিয়ে , রক্তের সাদা অংশ নিয়ে, সঠিক ব্যায়াম করে মোটামুটিভাবে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা গেলেও চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেকের পক্ষেই তা সম্ভব হয় না।
এধরনের রক্তরোগ ছাড়াও আরো অনেক বংশগত রোগ আছে যা স্বামী স্ত্রীর উভয় পরিবারে থাকলে সন্তানের রোগী হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
তাই সচেতনতার মাধ্যমে প্রতিরোধ করাই উত্তম।
Last Updated on 21/06/2020 by Editorial Staff
Comments
ইয়ে, বিয়ে, অতপর সন্তানাদি — No Comments
HTML tags allowed in your comment: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>