রাজরোগ হিমোফিলিয়া, রাজপতনে হিমোফিলিয়া
লিখেছেন ডাঃ অখিল রঞ্জন বিশ্বাস
ছবির রাজকীয় পোষাকের কিশোরটির নাম জারেভিচ (জারপুত্র) এলেক্সিস, রাশিয়ার শেষ জার নিকোলাস ও জারিনা আলেক্সান্দ্রা (বৃটিশ রাজকুমারী এলিক্স) এর একমাত্র পুত্র। স্রেফ সুন্দর একটি পোজ দেবার জন্য তাঁর বাঁ পাটা একটু উচুতে দিয়ে দাঁড়ানো কিন্তু নয়। আসলে বাম হাঁটুটা সোজা করতে না পারার জন্যই এভাবে দাঁড়ানো। আর এই হাঁটু সোজা করতে না পারার কারন হিমোফিলিয়া, যার সম্পর্কে বলা হয় এটা রোগ মূলতঃ রক্তের কিন্তু এর প্রভাব পড়ে মূলতঃ অস্থি সন্ধি আর মাংস পেশীতে। অস্থি সন্ধির ভিতরে বার বার রক্ত ক্ষরণের কারনে নড়ন ক্ষমতা কমে যাওয়া সহ অস্বাভাবিক রক্ত ক্ষরণজনিত নানা উপসর্গে প্রকাশ পায় হিমোফিলিয়া।
১৮৩৭ সালে বৃটিশ রাজ সিংহাসনে আরোহনকারী মহারানী ভিক্টোরিয়া ছিলেন হিমোফিলিয়া রোগের বাহক। তাঁর এক পূত্র লিওপোল্ড ছিলেন হিমোফিলিয় রোগী এবং দুই কন্যা বিয়াত্রিচ ও এলিস ছিলেন বাহক। রানী ভিক্টোরিয়ার দুই কন্যা ও নাতনীদের বিবাহের সূত্রে এই রোগ ছড়িয়ে যায় স্পেন, জার্মান ও রুশ রাজ পরিবারে। এমনই এক নাতনী হচ্ছেন রাজকুমারী এলিসের কন্যা এলিক্স যিনি রুশ জার নিকোলাসকে বিয় করে জারিনা আলেক্সান্দ্রা নাম ধারণ করেন, যাদের পূত্র এই ছবির কিশোর এলেক্সিস, যার জন্ম ১৯০৪ -এ। এজন্য হিমোফিলিয়াকে রাজ রোগও বলা হয়ে থাকে।
এরও বেশ আগে ১৮০৩ সালে জন কনরাড ওটো এবং ১৮১৩ সালে জন হে ধারণা দেন যে হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত হয় পুরুষরা এবং নারীরা এটির বাহক। রোগটির নামকরন হয় তারও পরে, ১৮২৮ সালে, সুইস ছাত্র ও শিক্ষক যথাক্রমে ফ্রেডরিক হফ ও অধ্যাপক শোনলেন এর নাম দেন haemorrhaphilia যেটিকে পরে তাঁরা সংক্ষেপে haemophilia বলেন। তবে হিমোফিলিয়া রোগ সম্পর্কে যে মানুষের ধারণা ছিল সুদূর অতীতে খৃষ্টীয় ২য় শতকে তার প্রমান, ঐ সময়ে ইহুদি রাব্বীরা বিধান দেন কোন ছেলের সহোদর ২ ভাই খৎনা করার পরে রক্ত ক্ষরণে মারা গেলে ঐ ছেলে খৎনা করার ধর্মীয় বাধ্য বাধকতা থেকে মুক্ত থাকবে।
হিমোফিলিয়া রোগের কারন হিসেবে রক্তে একটি উপাদানের ঘাটতি এবং সে উপাদানকে এন্টি হিমোফিলিক ফ্যাক্টর হিসেবে চিহ্নিত করা হয় অনেক পরে ১৯৩৯ সালে। এর পরে ১৯৫০ এর দশকে আরো ১১ রক্ত জমাট বাঁধতে দরকারী উপাদান চিহ্নিত হয় যার মধ্যে ছিল ২য় আরেকটি এন্টি হিমোফিলিক ফ্যাক্টর, পূর্বে চিহ্নিতটিকে Anti haemophilic factor A নামকরণ করে এটির নাম করণ হয় Anti haemophilic factor B হিসেবে। পরে রোমান ক্রমিকে সাজালে এদের নাম্বার হয় যথাক্রমে Factor VIII ও Factor IX. অর্থাৎ এতদিনে জানা গেল হিমোফিলিয়া দুই ধরণের- হিমোফিলিয়া এ ও হিমোফিলিয়া বি।
১৯০০ সালের দিকে রক্তের গ্রুপ আবিস্কার এবং ১৯৩০ এর দশকে রক্তের লোহিত কনিকা ও প্লাজমা আলাদা করা গেলেও হিমোফিলিয়া রোগের চিকিৎসায় এগুলোর ব্যবহার শুরু ২য় বিশ্বযুদ্ধ কালে। পরবর্তীতে ১৯৬০ সালে রক্তের প্লাসমা থেকে FVIII সমৃদ্ধ cryoprecipitate আলাদা করার মাধ্যমে হিমোফিলিয়া এর চিকিৎসা সক্ষমতা প্রায় পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়।
১৯৭০ এর দশকে প্লাসমা থেকে ঘনীভূত F VIII ও F IX আলাদা করার সক্ষমতা হিমোফিলিয়া রোগীদেরকে বলতে গেলে স্বাভাবিক দৈনন্দিন জীবনের অধিকার দিতে সমর্থ হয়। তবে এগুলো শরীরে প্রবেশ করানো থেকে রক্ত বাহিত কিছু মারাত্মক ভাইরাস সংক্রমনের ঝুঁকি সামান্য হলেও রয়েই যায়, যেটা দূর হয়ে যায় ১৯৯২ সালে recombinant DNA technology এর মাধ্যমে ঘনীভূত Factor উৎপাদনে সক্ষম হওয়ার থেকে।
তবে এত কিছুর পরেও যি বিষয়টি সবচেয়ে বড় মাথাব্যাথার কারন হিসেবে বিদ্যমান রয়েছে সেটি এর চিকিৎসা ব্যায়। উন্নত দেশগুলোতে রোগীদের প্রায় স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করতে মারাত্মক হিমোফিলিয়া রোগীদেরকে নিয়মিত প্রতিরোধমূলক Factor injection দেয় হয়, যেটার খরচ বাংলাদেশী টাকায়, প্রচলিত বাজার মূল্যে, ৫০ কেজি ওজনের একজন মানুষের জন্য প্রতি সপ্তাহে ১,৫০,০০০ (দেড় লক্ষ) এর উপরে। সে খরচ বহন করা বাংলাদেশের মত অর্থনৈতিক সক্ষমতার দেশে প্রায় অকল্পনীয়। আমরা যেটা করতে পারি সেটা হল ‘চাহিদা সাপেক্ষে Factor injection’ অর্থাৎ রক্ত ক্ষরণ হলে factor injection দেয়া। এই নীতিমালা অনুযায়ী factor ব্যবহার করতে গেলেও মারাত্মক ও মাঝারি মাত্রার হিমোফিলিয়া রোগীদের একসাথে বিবেচনায় নিলে প্রতি বছর এদের একজনে গড়ে ১৫ থেকে ২০ দিন Factor নেয়া লাগতে পারে। রোগীর ওজন ৫০ কেজি হলে তার খরচও বছরে ১০ থেকে ১৫ লক্ষ হতে পারে, যে অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের বাৎসরিক মোট আয়ের চেয়ে বেশী। তাই এই ব্যায় মেটানো আমাদের প্রায় সব রোগীর জন্য দুঃসাধ্য। আমাদের দেশে ধারণামতে ১৬ হাজার হিমোফিলিয়া রোগী থাকার কথা যাদের মধ্যে অন্তত ৪ – ৫ হাজার (মারাত্মক ও মাঝারি মাত্রার) রোগীর এমন চিকিৎসা প্রয়োজন। World Federation of Hemophilia -এর বদান্যতায় আমরা কিছু রোগীদেরকে খানিকটা চিকিৎসা সুবিধা দিতে পারছি হয়তো, তবে এর জন্য বেশী প্রয়োজন আভ্যন্তরীন সম্পদের সংস্থান- হতে পারে সরকারী বা বেসরকারী উদ্যোগে।
উপরন্তু এই on demand factor replacement নীতিতে চিকিৎসার মাধ্যমে সাফল্যের আরো কিছু গুরুত্বপূর্ন উপাদান হচ্ছে আঘাত বাঁচিয়ে চলা, আঘাত লাগে না এমন শরীর চর্চা, খেলাধুলা চালিয়ে যাওয়া ও ওজন নিয়ন্ত্রন এবং প্রয়োজন মত সুনির্দিষ্ট ফিজিওথেরাপি, যাগুলোর জন্য আর্থিক ও সাংগঠনিক সক্ষমতার দায় যথেষ্ট। সর্বোপরি এই on demand চিকিৎসার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে সময়মত চিকিৎসা নেওয়া, যেটা না করা গেলে চিকিৎসা ব্যায় যেমন বাড়ে, সাফল্যও তেমন কমে। এই সত্যের আলোকে এবারে বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবসের স্লোগান ‘Reaching Out: The First Step to Care’ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
তো এমন অবস্থায় একটি প্রশ্ন এসে যায় যে হিমোফিলিয়া রোগকে কি প্রতিরোধ করা যায় না, যেমনটি করার জন্য বিশ্যব্যাপী উদ্যোগ বিদ্যমান অন্য একটি বংশগত রক্তরোগ থ্যালাসেমিয়ার জন্য। এক কথায় বলতে গেলে জন্মের পূর্বে হিমোফিলিয়া রোগের প্রতিরোধ বিধেয় নয়; কেন নয় সেটা নিয় অন্য কোন সময়ে বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছা রইল। তবে একটি তথ্য শুধু বলে রাখি যে উপযুক্ত চিকিৎসা পেলে একজন হিমোফিলিয়া রোগী সম্পূর্ণ স্বাভাবিক কার্যকর জীবন পেতে পারেন যেটা মারাত্মক থ্যালাসেমিয়া রোগীর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সম্ভব নয়।
সবশেষে আবার একটু ইতিহাসে ফিরি। জারেভিচ এলেক্সিসের কৌশোর কাল, বিংশ শতাব্দীর ২য় দশকে কোন কার্যকর চিকিৎসা ছিল না হিমোফিলিয়ার সেটা আমরা জানি। আর এ কারনে তাঁর চিকিৎসায় জার পরিবারের ভরসা ছিল তান্ত্রিক ও সম্মোহন চিকিৎসক রাসপুটিনের উপর যিনি জারেভিচের অন্তত ব্যথা উপশমের ব্যাপারে বেশ সফল ছিলেন। ফলে জার পরিবার তথা রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণে রাসপুটিনের ছিল অগাধ ক্ষমতা। উপরন্তু ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী স্বাস্থ্য নিয়ে মহামান্য জার নিকোলাস নিরন্তর বিচলিত থাকার কারনে রাষ্ট্রাচারে তাঁর ঔদাসিন্যে হয়তো রুশ জনগনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের কারন হয়েছিল অনেকটা। রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লবের পিছনে এটাও হয়তো ছিল অন্যতম কারন। যার ফলশ্রুতিতে অসুস্থ এলেক্সিস সহ পুরো জার পরিবার ও তাদের বিশ্বস্ত রাজ কর্মচারীরা বন্দী অবস্থায় হত্যাকান্ডের শিকার হন ১৭ ই জুলাই, ২০১৮ দিবাগত রাতে মস্কো থেকে ১৫০০ কিলোমিটার পূর্বে ইয়েকেতিনবার্গ শহরে। কে যানে, উপযুক্ত চিকিৎসা থাকলে হয়তো এই এলেক্সিসই নেতৃত্ব দিতেন ২য় বিশ্বযুদ্ধের পরে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের পথে গনতান্ত্রিক উত্তরনে, ইউরোপের অন্যান্য রাজতন্ত্রের মত। ইতিহাসের সেই গতিপথ অধিকতর মঙ্গলজনক হত কিনা সেই বিতর্ক এখানে সরিয়ে রেখে, এলেক্সিসের মত হিমোফিলিয়া রোগীরা উপযুক্ত চিকিৎসা পেয়ে তাদের সর্বোত্তম সম্ভাবনায় বিকশিত হোক, এটাই হোক বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবসের প্রত্যাশা।
Last Updated on 05/04/2020 by Editorial Staff
Comments
রাজরোগ হিমোফিলিয়া, রাজপতনে হিমোফিলিয়া — No Comments
HTML tags allowed in your comment: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>